শোনো বাবু, বউদি কিন্তু সব টের পায়।
সোহাগের কথা আর বলিসনি। টের পায় তো পায়। কী করবে সে?
যমুনার ভাবনা হল। নরেনবাবুর সাহস বড়ই বেড়েছে, এবার তার বিপদ।
শুনে খ্যাঁক করে উঠল তারক, বিপদ আবার কী? তোকে তো কতবার বলেছি, ওতে কিছু হয়। তোর আমিও রইলুম। কখনও কলঙ্ক রটিয়ে তোকে বিপদে ফেলব না। নরেনবাবুর সঙ্গে আমার পষ্টাপষ্টি কথা হয়ে গেছে।
কী কথা?
সামনের মাসে চাকরিতে জয়েন দেব।
নরেনবাবু অন্য মেয়েমানুষ দেখে নেয় না কেন?
যার যাকে পছন্দ। তোকে চোখে লেগেছে। ও বড় সর্বনেশে ব্যাপার। যাকে চোখে লাগে তার জন্য পুরুষমানুষ সব করতে পারে।
আমি কালই বাপের বাড়ি যাচ্ছি। লাথি–ঝাঁটা খাই, শুকিয়ে মরি, তাও ভালো। তবু নষ্ট হব না।
বিপদে ফেললি দেখছি। বলি, আমার মতো একটা মনিষ্যিকে যদি তোর সব দিয়ে থাকতে পারিস তবে নরেনবাবু দোষটা কী করল? সে দেখতে আমার চেয়ে ঢের ভালো। ফরসা চোখমুখে শ্রী–ছাঁদ আছে। আমি তার পাশে কী বল তো!
তুমি আমার স্বামী।
ওই তো তোর দোষ। স্বামীর মতো স্বামী হলেও না হয় বুঝতুম।
তুমি খারাপ লোক নও। তোমাকে লোভে পেয়েছে।
তোর মাথাটাই বিগড়েছে। আমি খারাপ নই? খুব খারাপ। কেউ আজ অবধি আমাকে ভালো। বলেনি।
আমি বলছি। ভালো করে ভেবে দ্যাখো।
নরেনবাবু তোকে চায়। এমনকী এ কথাও বলেছে, সে তোকে বিয়ে করতেও রাজি।
বিয়ে! বলে এমন অবাক হয়ে তাকাল যমুনা যেন ভূত দেখছে।
ভয় পাসনি। তোর একটু ধর্মভয় আছে আমি জানি। আমি সাফ বলে দিয়েছি, বিয়ে–টিয়ে নয় মশাই। আম বউ ছাড়ছি না। দু-দিন চার-দিন বড় জোর।
তোমার একটু বাধল না বলতে? নরকে যাবে যে!
সে দেরি আছে। নরকে মেলা লোকই যাবে। কলিকালে কি নরকযাত্রীর অভাব রে! আগে এ জন্মে কিছু জুত করে নিই। নরক তো আছেই কপালে।
যমুনা রাগ করে বলল , দেখ, আমি সাবিত্রী বেউলো নই, তবে যা বুঝেছি তাই বুঝেছি। আমাকে দিয়ে ওকাজ হবে না।
তুই বোকাও বটে রে! নরেনবাবুর কী মেয়েছেলের অভাব? তোর কত বড় ভাগ্য যে এত মেয়েছেলে থাকতে তুই–ই ও শালার চোখে পড়েছিস। আমি বলি, সময় থাকতে এসব ভাঙিয়ে নে। রূপ–যৌবন সব ভাঙিয়ে মা লক্ষ্মীকে ঘরে এনে তোল আগে।
মা–লক্ষ্মী এমন ঘরে লাথি মারতেও আসবে না। মনটা ঠিক করে ফেলেছিল যমুনা। এখানে থাকলে যে তার আর পরকাল বলে কিছু থাকবে তাও বুঝেছে। কিন্তু যায় কোথা? বাপের বাড়ি বলতে তুলসীপোঁতা গাঁয়ে একখানা ঝুপড়ি। এণ্ডি–গেণ্ডি অনেক ভাইবোনের সংসার। তার বাবা দাদ আর হাজার মলম বিক্রি করে, মা বেচে ঘুঁটে।
৩.
বাঁশঝাড়ের মধ্যে একটা তোলপাড় হচ্ছিল। ভোঁস–ভোঁস শ্বাসের শব্দ, সেইসঙ্গে কে যেন আঁ দাঁড় পাঁ দাঁড় ভাঙচে।
তারক ভয় খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, ও কী গো?
করালী চাপা গলায় বলল , চুপ!
কান খাড়া করে শুনছিল করালী। বাঁশবনের মধ্যে দুটো চোখ চকচক করে উঠল হঠাৎ।
আহ্লাদের গলায় করালী বলল , ওরে পাজি মাগি, এখেনে সেঁধিয়ে রয়েছিস! আয় আয় বলছি শিগগির।
বাঁশবনে প্রলয়ের শব্দ তুলে আর ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলতে–ফেলতে গরুটা বেরিয়ে এল। গরু না হাতি বোঝা ভার। বিশাল চেহারা।
উরেব্বাস রে! এই তোমার গোরু?
গরুটা করালীর গা–ঘেঁষে দাঁড়াল, তার গলা এক হাতে জড়িয়ে ধরে করালী বলল , আহা, বাঁজা বলেই ওর মনে সুখ নেই কিনা। মনের দুঃখে মাঝে-মাঝে বনবাসে যায়। ফিরেও আসে। চ’ চ’ পা চালিয়ে চ’। মেয়েটা এতক্ষণে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছে।
তারক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল , তুমি কপালওলা মানুষ, গরুটা দিব্যি পেয়ে গেলে। এখন আমার বউ কোথা পাই বলতে পারো? আমার কপাল তো আর তোমার মতো নয়।
পাবি–পাবি। বাঁধা বউ যাবে কোথায়? মারধর করিস নাকি?
আরে না। সেসব নয়, নরম–সরম আছে, গায়ে হাত তোলার দরকার হয় না। তবে গোঁ আছে। খুব। যেটা না বলবে সেটাকে হ্যাঁ করায় কার সাধ্যি।
রথতলার কাছ বরাবর করালী বাঁয়ের রাস্তা ধরল, তারক ডাইনে।
সামনেই মলয়া ফার্মেসি। আলো জ্বলছে। দিব্যি পাকা ঘর। দোকানও বড়সড়োই। আজ নরেনবাবু নেই। শ্রীপতি একা বসে মাছি তাড়াচ্ছে।
তাকে দেখে শ্রীপতি বিশেষ খুশি হল না। হওয়ার কথাও নয়। মুখটা আঁশটে করে বলল , বাবু নেই।
আসেনি আজ?
না। সকাল থেকেই পাত্তা নেই। বাড়ি থেকেও লোক এসে খুঁজে গেছে।
অ্যাঁ। তবে তো—
শ্রীপতি চেয়ে আছে। বুকটা ধকধক করছিল তারকের। তাড়ির নেশাটা কেটে যাওয়ার উপক্রম।
গেল কোথায় নরেনবাবু?
শ্রীপতি ঠোঁট উলটে বলল , তা কে জানে। বলে যায়নি কিছু। বাড়ির লোকও খুঁজছে।
দুইয়ে–দুইয়ে তবে কি চারই হল? যমুনা আর নরেনবাবু যদি একসঙ্গেই হাওয়া হয়ে থাকে তো শ্রীপতির জায়গায় সামনের মাসে সে-ই জয়েন দেবে।
তারক বসে গেল।
দোকানে বিক্রিবাটা কেমন হে?
বিক্রি কোথায়? ওষুধের স্টকই নেই।
নেই কেন?
ওষুধ কি মাগনা আসবে? টাকাটা দেবে কে?
কেন, নিতাইবাবু দেবে।
দিচ্ছে কোথায়? অন্য সব কারবারে টাকা আটকে আছে। দোকান চলছে, নমোনমো করে।
ইয়ে–তা উপরি–টুপরি কেমন?
উপরি! সেটা আবার কী? মাসমাইনেরই দেখা নেই তো উপরি।
তারক মৃদু-মৃদু হাসছিল। শ্রীপতি তো আর পাঁঠা নয় যে তার কাছে কবুল করবে।
নরেনবাবু বাড়িতে কিছু বলে যায়নি?
তা কে জানে। ঠসা–বোবা বউ, তাকে বলাও যা না-বলাও তা।