সোজাসাপটা ব্যাপার। এতে কোনও প্যাঁচ নেই। মানুষ কত কী চায়, আর চাইবেই তো! নেই বলেই চায়। কিন্তু চাইলেই তো হল না। দিচ্ছে কে? আর তখনই প্যাঁচটা লাগে।
মলয়ার দুটো মেয়ে। একটা সাড়ে তিন বছরের, একটা দু-বছরের। তারা কেউ বোবা–কালা নয়। বড়টা পাড়ার খেলুড়িদের সঙ্গে খেলতে শিখেছে, আর ছোেটটা সারা বাড়িতে গুটগুট করে হেঁটে বেড়ায়। এ দুটো মেয়ে হচ্ছে মলয়ার জান। যখন আদর করে তখন খ্যাপাটে হয়ে যায়। আর সারা দিনে মাঝে-মাঝেই মেয়েদের আঁ–আঁ করে ডাকে। মেয়ে দুটো মায়ের ডাক ঠিক বুঝতে পেরে ছুটে আসে। মেয়ে দুটোর দেখাশোনা করত উড়নচণ্ডী পটলী। ছোট মেয়েটা তখন সবে হামা দেয়। পটলী তাকে বারান্দায় ছেড়ে দিয়ে উঠোনে দিব্যি এক্কা–দোক্কা খেলছিল। মেয়েটা গড়িয়ে পড়ে হাঁ করে এমন টান ধরল যে দম বুঝি ফিরে পায় না। মাথা ফুলে ঢোল। শোনার কথাই নয় মলয়ার। তবু মায়ের মন বলে কথা। কোথা থেকে পাখির মতো উড়ে এসে মেয়ে বুকে তুলে নিল। তারপর সে কী তার ভয়ঙ্কর চোখ আর ভৈরবী মূর্তি। পটলী না পালালে বোধহয় খুনই হয়ে যেত মলয়ার হাতে। বোবাদের রাগ বোধহয় বেশিই হয়। কথা দিয়ে দুরমুশ করতে পারে না, গালাগাল দিয়ে বুক হালকা করতে পারে না, তাই ভিতরে ভিতরে পোষা রাগ গুমরে ওঠে।
পটলীর জায়গায় এখন যমুনা। মেয়েদের দেখে শোনে, ধান শুকোয়, উেঁকি কোটে, গেরস্ত বাড়িতে তো কাজের আকাল নেই। আবার ছুটে গিয়ে ঘরের অকালকুষ্মাণ্ড ওই তারকের জন্যও বেঁধে রেখে আসতে হয়। তা বলে খারাপ ছিল না যমুনা। খাটনিকে তো তার ভয় নেই, চিরকাল গতরে খেটেই বড়টি হল। কিন্তু ভয়টা অন্য জায়গায়। সে হল ওই মলয়া। বোবা কালা হলে কী হয়, যমুনার বিশ্বাস, মলয়া অনেক কিছু টের পায়। শুনতে না পেলেও টের পায়। মাঝে-মাঝে কেমন যেন বড়-বড় চোখ করে তার দিকে অপলক চেয়ে থাকে। একটু ভয়-ভয় করে যমুনার।
নরেনবাবু ধীরে-ধীরে এগোচ্ছে। একদিন বলল , নারী আর নদীতে কোনও তফাত নেই, বুঝলি মেয়েছেলে হল বওতা জল, ডুব দিয়ে উঠে পড়ো। নদী কি তাতে অশুদ্ধ হল? এই যে গঙ্গায় কত পাপী–তাপী ডুব দেয়, গঙ্গা কি তাতে ময়লা হয় রে!
আগে যমুনা শুধু শুনত, কিছু বলত না। আজকাল বলে। সে ফস করে বলে ফেলল, তোমার কি কোনও কাজ নেই বাবু? সকালের দিকটায় দোকানে গিয়ে বসলেও তো পারো। শ্রীপতি তো শুনি দোকান ফাঁক করে দিচ্ছে।
নরেনবাবু একটা ফুঃ শব্দ করে বলল , দিক না, তাতে আমার কী? দোকান শ্বশুরের, শ্রীপতিও তার লোক। সে বুঝবে। আমার ওতে মাথা গলানোর কী? আমি খাব–দাব ফুর্তি করব। বোবা কালা বিয়ে করেছি কি মাগনা?
শ্বশুর কি আর চিরকাল থাকবে? দোকান তো তোমারই হবে একদিন।
আমার নয় রে, আমার নয়। দোকান ওই বোবা–কালার নামে। ও আমি চাইও না। দু টাকার জিনিস চার টাকায় বিক্রি করে পয়সা কামানোর ধাতই আমার নয়। আমাকে কি তাই বুঝলি?
আর-একদিন আরও একটু এগোল নরেনবাবু। কথা নয়, একখানা তাঁতের শাড়ি দিয়ে বলল , কাল সকালে পরে আসিস। তোকে মানাবে। এসে একটু ঘোরাফেরা করিস চোখের সামনে।
খুশি হল তারকও। বলল , বাঃ-বাঃ, এই তো কাজ এগোচ্ছে।
তার মানে?
নরেনটা তো ভিতুর ডিম। ভাবছিলুম আর বুঝি এগোবে না।
কী বলতে চাও তুমি বলো তো!
দোষ ধরিসনি। একটু মাখামাখি করলে যদি কাজ হয় তো ভালোই।
তাই যদি হবে তাহলে তো বাজারে গিয়ে নাম লেখালেই পারতুম।
চটিস কেন? পেটের দায় বলে কথা। শ্রীপতি শালা তো শুনছি, কৈলাসপুরে চার কাটা জমি কিনে ফেলেছে।
তাতে তোমার কী?
জ্বলুনি হয়, বুঝলি, বুকের মাঝখানটায় বড্ড জ্বলুনি হয়। ঘরামির কাজ করে করে হাতে কড়া পড়ে গেল, সুখের মুখ দেখলাম না। প্রথমটায় বাধোবাধো ঠেকলেও পরে দেখবি ব্যাপারটা কিছুই না। আমিও যা, ওই নরেনবাবুও তা।
তোমার মুখে পোকা পড়বে।
ওরে শোন, ও চাকরির মতো সুখের চাকরি নেই। মালিক চোখ বুজে থাকে, হিসেব চায় না। এমনটা আর কোথায় পাবি?
এই টানা পোড়েনের মধ্যে দিন কাটছিল যমুনার। একদিন বিকেলে ভিতরের বারান্দায় বসে মলয়ার চুল বাঁধছিল যমুনা। বেশ চুল মেয়েটার। দেখতেও খারাপ নয় কিছু। মায়াও হয়। খোঁপায়। কাঁটা গুঁজে হাত–আয়নাটা মলয়ার হাতে যখন ধরিয়ে দিল তখন হঠাৎ আয়নাটা ফেলে ঘুরে বসল মলয়া। সেই বড়-বড় চোখ। দু-হাতের হঠাৎ যমুনার দু-কাঁধ খিমচে ধরে ঝাঁকায় আর বলে, আঁ আঁ–আঁ–আঁ–আঁ…
ভয়ে আত্মারাম, ডানা ঝাঁপটাচ্ছিল বুকে। কী জোর মেয়েটার গায়ে!
কী করছ বউদি, কী করছ? আমি তো কিছু করিনি।
মলয়া ঝাঁকানি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল তার চোখের দিকে। তারপর সাপে ব্যাং ধরলে ব্যাং যেমন শব্দ করে তেমনি এক অবোধ শব্দ বেরোতে লাগল তার গলা থেকে। আর দু চোখে জলের ধারা।
নরেনবাবু পরদিনই বলল , শহরে বেড়াতে যাবি দু-দিনের জন্য? শুধু তুই আর আমি। একটু ফুর্তি করে আসি চল।
ফুঁসে উঠতে পারল না যমুনা। তার কি সেই জোর আছে? জোর হল স্বামীর জোর। তার তো সেখানেই লবডঙ্কা। যমুনা সুতরাং অন্য পন্থা ধরে বলল , তোমার শ্বশুরকে যদি বলে দিই তাহলে কী হয়?
ও বাবা! এ যে আমার শ্বশুর দেখায়! কেন রে, শ্বশুরের কাছে কি টিকিখানাও বাঁধা রেখেছি? নিতাই রায়ই বা কম কীসে? পটলডাঙায় তার বসন্তকুমারীর ঘরে যাতায়াত কে না জানে? কী করবে সে আমার? তুই বড্ড বোকা মেয়েছেলে তো!