উনুন ঝিমিয়ে পড়েছে বাপু। এখন আঁচ তুলতে গেলে কয়লা দিতে হবে। শেষ হাটে আর আঁচ তুলে লোকসান দেব নাকি দু-টাকার ফুলুরির জন্য?
তা বটে। তারক এধার-ওধার খুঁজে দেখল। শেষে মুকুন্দ দলুইয়ের দোকানে গরম চপ পেয়ে নিয়ে এল।
খালি পেটে ঢুকে চপ যেন নৃত্য করতে লাগল। তার ওপর তাড়ি গিয়ে যেন গান ধরে ফেলল। ভিতরে যখন নাচগান চলছে তখন তারক বলল , কালীপুরের হাট বড় ভালো জায়গা, কী বলো কারালীদা!
জিবে একটা মারাত্মক কাঁচালঙ্কার ঘষটানি খেয়ে শিসোচ্ছিল করালী। এক গাল তাড়িতে জলন্ত জিবটা খানিক ভিজিয়ে রেখে ঢোঁক গিলে বলল , সেই কোমরে ঘুনসি–পরা বয়সে বাপের হাত ধরে আসতুম, তখন একরকম ছিল। এখন অন্যরকম।
তারকের বাঁ-পাশে একজন দাঁত উঁচু লোক তখন থেকে দুখানা সস্তা গন্ধ সাবান বাঁ-হাতে ধরে বসে আছে। ডান হাতে গেলাসে চুমুক দিচ্ছে আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাবান দু-খানা দেখছে বারবার।
পেটের মধ্যে নৃত্যগীত চলছে, মেজাজটা একটু ঢিলে হয়েছে তারকের। লোকটার দিকে চেয়ে বলল , সাবান বুঝি বউয়ের জন্য?
লোকটা উদাস হয়ে বলল , বউ কোথা? ঘাড়ের ওপর দু-দুটো ধুমসি বোন, মা-বাপ। মুকুন্দ বিশ্বেস সাফ বলে দিয়েছে, আগে পরিবার থেকে আলগা হও, তারপর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব।
তা আলগা হতে বাধা কী? হলেই হয়। আজকাল সবাই হচ্ছে।
ভয়ও আছে। মুকুন্দ বিশ্বেসের ছেলের সঙ্গে তার ঝগড়া। মেয়ের বিয়ে দিয়েই মুকুন্দ আর তার বউ আমার ঘাড়ে চাপবার মতলব করছে।
ও বাবা! সেও তো গন্ধমাদন।
তাই আর বিয়েটা হয়ে উঠছেনা।
করো কী?
ভ্যানরিকশা চালাই। নয়াপুর থেকে কেশব হালদারের মাল নিয়ে এসেছি। হাটের পর ফের মাল নিয়ে ফেরা। আর সাবানের কথা বলছ! সে কি আর শখ করে কেনা! লটারিতে পেলুম।
বাঃ। লটারি মেরেছ, এ তো সুখের কথা।
ছাই। ওই যে লোহার রিং ছুঁড়ে– ছুঁড়ে জিনিসের ওপর ফেলতে হয়। রিং-এর মধ্যিখানে যা পড়বে তা পাবে। ফি বার দু-টাকা করে। তিরিশখানা টাকা গচ্চা গেল। তার মধ্যে একবার এই সাবান দু-খানা উঠল। যাচাই করে দেখেছি, এ সাবান চার টাকা পঞ্চাশ পয়সায় বিকোয়।
লটারি মানেই তো তাইরে ভাই। তুমিই যদি সব জিতে যাও তাহলে লটারিওয়ালার থাকবে কী?
দাঁত–উঁচু লোকটা এক চুমুক খেয়ে বলল , সবারই সব হয়, শুধু এই ভ্যানগাড়িওয়ালারই কিছু হয় না, বুঝলে! মা একখানা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছিল, ট্যাঁকে আছে এখনও। সেসব আর নেওয়া হবে না। ক’টা বাজে বলল তো!
তারকের হাতে ঘড়ি নেই। আন্দাজে বলল , তা ধরো সাতটা সাড়ে-সাতটা হবে।
উরেব্বাস রে! কেশব হালদার মাল গোটাতে লেগেছে। যাই।
করালী শিসোচ্ছিল।
উঠবে নাকি গোকরালীদা।
করালী একটা হাই তুলে বলল , গরুটার কথাই ভাবছিলুম।
কী ভাবলে?
বাঁজা গরু। পুষতে খরচ আবার বেচতেও মন চায় না। কিনবেই বা কে বল!
তাই বলো, বাঁজা গরু। তা গেছে আপদই গেছে। ভাবনার কী?
আছে রে আছে। আমার ছোট মেয়ে পদীর বড় ভাব গরুটার সঙ্গে।
পাল খাইয়েছ?
কিছু বাকি রাখিনি। আর দুটো গরু বিয়োয়, দুধও দেয়। এটাই দেয় না।
এত বড় হাটে বউ খোঁজা মানে খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার শামিল। এসে থাকলেও এত রাত অবধি তো আর হাটের মাটি কামড়ে সে নেই। বউ যদি রাতে না ফেরে তাহলে রাতেও হরিমটর। তারক ভাবছিল আরও কয়েকখানা চপ সাঁটিয়ে নেবে কি না। তারপর এক ঘটি জল খেয়ে নিলেই হল। কিন্তু পয়সার নেশাটা চৌপাট হয়ে গেলে মুশকিল।
২.
পুরুষমানুষ আর মেয়েমানুষের সম্পর্ক নাকি চিড়েন। আ মোলো। সম্পর্কের আবার চিড়েতন, হরতন, ইস্কাপন, রুইতন হয় নাকি? হলেও বাপু, যমুনা কি সেসব বোঝে! তবে কিনা নরেনবাবু ভ ভদ্রলোক, মেলা জানেশোনে। নরেনবাবুর কথা তো আর ফ্যালনা নয়।
একদিন জিগ্যেস করেছিল, চিড়েতনটা আবার কী, বলো তো বাবু?
নরেনবাবু হেসেটেসে বলল , এই ধর তুই আর আমি। আমিও কারও কেউ নই, তুইও কারও কেউ নোস। যেমন জলের মাছ, কে কার মা-বাপ জানে ওরা? তবু তো ডিম ছাড়ছে, বাচ্চা বিয়োচ্ছে। ব্যাপারটা ওরকমই আর কি। চিরন্তন মানে হচ্ছে আদি সম্পর্ক বুঝলি না?
যমুনা বুঝি–বুঝি করেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না। তবে এটা ঠাহর হল যে, ওই চিড়েতনের মধ্যেই প্যাঁচটা আছে।
প্যাঁচ বুঝতে যমুনার কেন–কোনও মেয়েমানুষেরই দেরি হয় না। যমুনার এই সতেরো বছর বয়স হল। এক বছর হল পুরুষমানুষ ঘাঁটছে। পুরুষটা হল তার বর তারক। একদিন মিটমিট করে হেসে বলেছিল, বাবুর বাড়িতে কাজে যাস, তা কখনও পিট–ঠিট চুলকে দিতে বললে দিস। নরেনবাবুর মেলা পয়সা। পাঁচ বুঝতে যমুনার দেরি হয় না।
আর একদিন বলল , আহা, বাবুর বউটা বোবা, পীরিতের কথাটথা কইতে পারে না। পুরুষমানুষ একটু ওসব শুনতে–টুনতে চায়।
প্যাঁচ। যমুনা বুঝতে পারে। চিড়েতনটা বুঝতেও তার অসুবিধে হয়নি।
নরেনবাবুর বউ মলয়া বোবা–কালা। তবে সে পয়সাওলা নিতাই রায়ের মেয়ে। নিতাই রায় পঞ্চাশ হাজার টাকায় নরেনবাবুকে কিনেছে। এ কথা সবাই জানে। নগদ ছাড়াও বাড়িঘর ঠিকঠাক করে দেওয়া, মেয়ের নামে জমিজমা লিখে দেওয়া তো আছেই। নরেনবাবুকে তাই আর কিছু করতে হয় না। শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটছিল। তবে বেকার জামাই বলে লোকে টিটকিরি না দেয় সেজন্য ইদানীং নয়নপুরের বাজারে একখানা ওষুধের দোকানও করে দিয়েছে। নিতাই রায়। গাঁয়ের দোকান, সেখানে ওষুধ ছাড়াও নানা জিনিস রাখতে হয়। তা নরেন হল বাবু মানুষ। সকালের দিকে শ্রীপতি নামে এক কর্মচারী দোকান দেখে, সন্ধেবেলা নরেনবাবু গিয়ে। ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে আসে। সেখানে কিছু ইয়ারবন্ধুও জোটে এসে। শোনা যাচ্ছে, নরেনবাবুর গদাইলস্করি চালে সুবিধে হয়েছে শ্রীপতির। সে দু-হাতে লুটে নিচ্ছে। তারকের তাই ইচ্ছে, শ্রীপতিকে সরিয়ে চাকরিটা সে বাগায়।