একটু হতাশ হল নীলু। হয়তো রাতের সেই ছেলেটা সত্যিই সাধন ছিল না, নয়তো এখনকার মানুষ পরস্পরের মুখ বড় তাড়াতাড়ি ভুলে যায়।
নীলু গলা উঁচু করে বলল–তোমার মেয়ে দুটো বড় কাণ্ড করছে বল্লরী, ওদের নিয়ে যাও।
–আঃ, একটু রাখুন না বাবা, আমি প্রায় ঘরে পৌঁছে গেছি।
রাত্রির শো-তে শোভন আর বল্লরী জোর করে টেনে নিয়ে গেল নীলুকে। অনেক দামি টিকিটে বাজে একটা বাংলা ছবি দেখল তারা। তারপর ট্যাক্সিতে ফিরল।
জ্যোৎস্না ফুটেছে খুব। ফুলবাগানের মোড়ে ট্যাক্সি ছেড়ে জ্যোৎস্নায় ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল নীলু রাস্তা ফাঁকা। দুধের মতো জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের ডাকা নিরপেক্ষ মানুষেরা তারই আড়ালে শুয়ে আছে। দূরে দূরে কোথাও পেটো ফাটবার আওয়াজ ওঠো মাঝে-মধ্যে গলির মুখে মুখে যুদ্ধের ন্যূহ তৈরি করে লড়াই শুরু হয়। সাধন আছে ওই দলে কে জানে একদিন হয়তো তার নামে একটা শহীদ স্তম্ভ উইঢিবির মতো। গজিয়ে উঠবে গলির মুখো।
পাড়া আজ নিস্তব্ধ। তার মানে নীলুর ছোটলোক বন্ধুরা কেউ আজ মেজাজে নেই। হয়তো বৃটিশ আজ মাল খায়নি, জগু আর জাপান গেছে ঘুমোতো ভাবতে ভালই লাগে।
শোভন আর বল্লরীর ভালবাসার বিয়ে বড় সংসার ছেড়ে এসে সুখে আছে ওরা। কুসুমের বাবা শেষ পর্যন্ত মত করলেন না। এই বিশাল পরিবারে তাঁর আদরের মেয়ে এসে অথই জলে পড়বো বাসা ছেড়ে যেতে পারল না নীলু যেতে কষ্ট হয়েছিল কষ্ট হয়েছিল কুসুমের জন্যও। কোনটা ভাল হত তা সে বুঝলই না। একা হলে ঘুরে-ফিরে কুসুমের কথা বড় মনে পড়ে।
বাবা ফিরবে পরশু আরও দুদিন তার কিছু চাক্কি ঝাঁক যাবে। হাসি মুখেই মেনে নেবে নীলু। নয়তো রাগই করবো কিন্তু ঝাঁক হবেই। বাবা ফিরে নীলুর দিকে আড়ে আড়ে অপরাধীর মতো তাকাবে, হাসবে মিটিমিটি খেলটুকু ভালই লাগবে নীলুর। সে এই সংসারের জন্য প্রেমিকাকে ত্যাগ করেছে–কুসুমকে–এই চিন্তায় সে কি মাঝে মাঝে নিজেকে মহৎ ভাববে?
একা থাকলে অনেক চিন্তার টুকরো ঝরে-পড়া কুটোকাটার মতো মাথার ভিতরে চক্কর খায়।
বাড়ির ছায়া থেকে পোগো হঠাৎ নিঃশব্দে পিছু নেয়। মনে মনে হাসে নীলু। তারপর ফিরে বলে–পোগো, কী চাস?
পোগা দূর থেকে বলে–ঠালা, টোকে মার্ডার করব।
ক্লান্ত গলায় নীলু বলে–আয়, করে যা মার্ডার।
পোগো চুপ থাকে একটু সতর্ক গলায় বলে–মারবি না বল!
বড় কষ্ট হয় নীলুর। ধীরে ধীরে পোগোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে–মারব না। আয়, একটা সিগারেট খা।
পোগো খুশী হয়ে এগিয়ে আসে।
নিশুত রাতে এক ঘুমন্ত বাড়ির সিঁড়িতে বসে নীলু, পাশে পাগলা পোগো সিগারেট ধরিয়ে নেয় দুজনে। তারপর–নীলু কখনও কাউকে বলতে পারে না–সেই হৃদয়ের দুঃখের গল্প–কুসুমের গল্প–অনর্গল বলে যায় পোগোর কাছে।
পোগো নিবিষ্ট মনে বুঝবার চেষ্টা করে।
পরপুরুষ
করালী গরু খুঁজতে বেরিয়েছিল। আর তারক বেরিয়েছিল বউ খুঁজতে।
কালীপুরের হাটে সাঁঝের বেলায় দুজনে দেখা।
বাঁ-চোখে ছানি এসেছে, ভালো ঠাহর হয় না। তবু তারককে চিনতে পেরে করালী বলল , তারক নাকি?
আর বলো কেন দাদা। মাগি সকালে থেকে হাওয়া।
ঝগড়া করেছিস?
সে আর কোনদিন না হচ্ছে! আজ আবার বাগান থেকে মস্ত মানকচুটা তুলে নিয়ে বেরিয়েছে। আমি ভাবলুম কচু বেচতে যদি হাটে এসে থাকে।
বাঁধা বউ, ঠিক ফিরে যাবে। আমার তো তা নয়। গরু বলে কথা, অবোলা জীব। হাটে যদি হাতবদল হয় তো মস্ত লোকসান।
গো–হাটা ঘুরে দেখেছ?
তা আর দেখিনি! পেলুম না।
ভেবোনা। গরুও ফিরবে। চল, পরানের দোকানে বসি।
পরাণ তাড়ির কলসি সাজিয়ে বসে, একখানা বারকোশে ভাঁড় আর কাঁচের গেলাস সাজানো। আশেপাশে খদ্দেররা সব উবু হয়ে বসে ঢকঢক গিলছে। দুজনে সেখানে সেঁটে গেল।
কালীপুরের হাট একখানা হাটের মতো হাটই বটে। দশটা গাঁ যেন ভেঙে পড়ে। জিনিস যেমন সরেস দামও মোলায়েম। এই সন্ধের পরও হ্যাজাক, কারবাইড, টেমি জ্বেলে বিকিকিনি চলছে রমরম করে। হাটেবাজারে এলে মনটা ভালো থাকে তারকের। পেটে তাড়ি টাড়ি গেলে তো আরও তর হয়ে যায়। তবে কিনা বউটা সকালবেলায় পালিয়ে যাওয়ায় আজ সারাদিন হরিমটর গেছে। রান্নাটা আসে না তারকের। ছেলেবেলায় এই কালীপুরের হাটেই এক জ্যোতিষী তার মাকে বলেছিল, বাপু, তোমার ছেলের কিন্তু অগ্নিভয় আছে। আগুন থেকে সাবধানে রেখো। তাই মা তাকে গা ছুঁইয়ে বাক্যি নিয়েছিল, আগুনের কাছে যাবে না। মায়ের কথা ভাবতেই চোখটা জ্বালা করল। মা মরে গিয়ে ইস্তক কিছু ফাঁকা হয়ে গেছে যেন। দুপুরে গড়াননা বেলায় মুকুন্দর দোকানে চারটি মুড়ি–বাতাসা চিবিয়েছিল। এখন খিদেটা চাগাড় মারছে।
করালী যেন মনের কথা টের পেয়েই বলল , নন্দকিশোরের মোচার চপ খাবি?
খুব খাব।
পয়সা দিচ্ছি, যা নিয়ে আয়।
নন্দকিশোরের মোচার চপের খুব নামডাক। সারা দিনে দোকানে যেন পাকা কাঁঠালে মাছির মতো ভিড়। এখন সন্ধেবেলায় ভিড় একটু পাতলা হয়েছে। সারা দিনে না হোক কয়েক হাজার টাকার মাল বিক্রি করে নন্দকিশোরের হ্যাদানো চেহারা। চারটে কর্মচারীও নেতিয়ে পড়েছে যেন।
নন্দকিশোর মাথা নেড়ে বলল , মোচা কখন ফুরিয়ে গেছে। ফুলুরি হবে। তবে গরম নয়।
আহা একটু গরম করে দিলেই তো হয়।