নীলু শান্তভাবে একটু মুচকি হাসে–কিন্তু তোমার নালিশ ছিল বলছিলে যে! এ তো নালিশ নয়। প্রশংসা।
–না নালিশই। কারণ, আজ সকালে হঠাৎ গোটা দুই বড় বড় ছেলে এসে হাজির। বলল–আপনাদের দেয়ালে ওসব লেখা কেন? আপনারা কেন এসব আলাউ করেন? আপনার বন্ধু। ঘটনাটা বুঝিয়ে বলতে ওরা থমথমে মুখ করে চলে গেল। আপনি ওই ছ’জনকে যদি চিনতে পারেন তবে বলবেন–ওরা যেন আর আমাদের দেয়ালে না লেখো লিখলে আমরা বড় বিপদে পড়ে যাই। দুদলের মাঝখানে থাকতে ভয় করে আমাদের বলবেন যদি চিনতে পারেন।
শোভন মাথা নেড়ে বলে–তার চেয়ে নীলু, তুই আমার জন্য আর একটা বাসা দেখা এই। দেয়ালের লেখা নিয়ে ব্যাপার কদূর গড়ায় কে জানে। এর পর বোমা কিংবা পেটো ছুড়ে দিয়ে যাবে জানালা দিয়ে, রাস্তায় পেলে আলু টপকাবো তার ওপর বল্লরী ওদের চা খাইয়েছে–যদি সে ঘটনার সাক্ষীসাবুদ কেউ থেকে থাকে তবে এখানে থাকাটা বেশ রিস্কি এখন।
বল্লরী নীলুর দিকে চেয়ে বলল–বুঝলেন তো! আমাদের কোনো দলের ওপর রাগ নেই। রাতজাগা ছটা ছেলেকে চা খাইয়েছি–সে তো আর দল বুঝে নয়! অন্য দলের হলেও খাওয়াতুম।
বেরিয়ে আসার সময়ে দেয়ালের লেখাটা নীলু একপলক দেখল। তেমন কিছু দেখার নেই। সারা কলকাতার দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিপ্লবের ডাক। নিঃশব্দে।
কয়েকদিন আগে এক সকালবেলায় হরলালের জ্যাঠামশাইকে নীলু দেখেছিল প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেরার পথে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন দেওয়ালের সামনে পড়লেন লেখা। নীলুকে দেখে ডাক দিলেন তিনি বললেন–এইসব লেখা দেখেছ নীলু। কী রকম স্বার্থপরতার কথা। আমাদের ছেলেবেলায় মানুষকে স্বার্থত্যাগের কথাই শেখানো হত। এখন এরা শেখাচ্ছে স্বার্থসচেতন হতে, হিংস্র হতে–দেখেছ কীরকম উল্টো শিক্ষা!
নীলু শুনে হেসেছিল।
উনি গম্ভীর হয়ে বললেন–হেসো না। রামকৃষ্ণদেব যে কামিনীকাঞ্চন সম্বন্ধে সাবধান হতে বলেছিলেন তার মানে বোঝো?
নীলু মাথা নেড়েছিল। না।
উনি বললেন–আমি এতদিনে সেটা বুঝেছি। রামকৃষ্ণদেব আমাদের দুটো অশুভ শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হতে বলেছিলেন একটা হচ্ছে ফ্রয়েডের প্রতীক কামিনী, অপরটা মার্ক্সের কাঞ্চনা ও দুই তত্ত্ব পৃথিবীকে ব্যভিচার আর স্বার্থপরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তোমার কী মনে হয়?
নীলু ভীষণ হেসে ফেলেছিল।
হরলালের জ্যাঠামশাই রেগে গিয়ে দেয়ালে লাঠি ঠুকে বললেন–তবে এর মানে কী? অ্যা! পড়ে দেখ, এ সব ভীষণ স্বার্থপরতার কথা কি না।
তারপর থেকে যতবার সেই কথা মনে পড়েছে ততবার হেসেছে নীলু একা একা বেলা বেড়ে গেছে। বাসায় খবর দেওয়া নেই যে শোভনরা খাবো খবরটা দেওয়া দরকার। ফুলবাগানের মোড় থেকে নীলু একটা শর্টকাট ধরল। বড় রাস্তায় যেখানে গলির মুখ এসে মিশেছে সেখানেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাধন–নীলুর চতুর্থ ভাই। কলেজের শেষ ইয়ারে পড়ে। নীলুকে দেখে সিগারেট লুকোল। পথচলতি অচেনা মানুষের মতো দুজনে দুজনকে চেয়ে দেখল একটু চোখ সরিয়ে নিলা। তাদের দেখে কেউ বুঝবে না যে তারা এক মায়ের পেটে জন্মেছে, একই ছাদের নীচে একই বিছানায় শোয়! নীলু শুধু জানে সাধন তার ভাই। সাধনের আর কিছুই জানে না সে কোন দল করছে সাধন, কোন পথে যাচ্ছে, কেমন তার চরিত্র–কিছুই জানা নেই নীলুর। কেবল মাঝে মাঝে ভোরবেলা উঠে সে দেখে সাধনের আঙুলে, হাতে কিংবা জামায় আলকাতরার দাগ। তখন মনে পড়ে, গভীর রাতে ঘুমোতে এসেছিল সাধনা।
এখন কেন জানে না, সাধনের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল নীলুর সাধন, তুই কেমন আছিস? তোর জামাপ্যান্ট নিয়েছিস তুই? অনার্স ছাড়িসনি তো! এরকম কত জিজ্ঞাসা করার আছে।
একটু এগিয়ে গিয়েছিল নীলু। ফিরে আসবে কিনা ভেবে ইতস্তত করছিল। মুখ ফিরিয়ে দেখল সাধন তার দিকেই চেয়ে আছে। একদৃষ্টো হয়তো জিজ্ঞেস করতে চায়–দাদা, ভাল আছিস তো? বড্ড রোগা হয়ে গেছিস, তোর ঘাড়ের নলী দেখা যাচ্ছে রে! কুসুমদির সঙ্গে তোর বিয়ে হল না শেষ পর্যন্ত, না? ওরা বড়লোক, তাই? তুই আলাদা বাসা করতে রাজি হলি না, তাই? না হোক কুসুমদির সঙ্গে তোর বিয়ে–কিন্তু আমরা–ভাইয়েরা তো জানি তোর মন কত বড়, বাবার পর তুই কেমন আগলে আছিস আমাদের! আহারে দাদা, রোদে ঘুরিস না, বাড়ি যা। আমার জন্য। ভাবিস না–আমি রাতচরা–কিন্তু নষ্ট হচ্ছি না রে, ভয় নেই!
কয়েক পলক নির্জন গলিপথে তারা দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে এরকম নিঃশব্দে কথা বলল। তারপর সামান্য লজ্জা পেয়ে নীলু বাড়ির দিকে হেঁটে যেতে লাগল।
দুপুরে বাড়িতে কাণ্ড হয়ে গেল খুব নাড়মামী কলকল করে কথা বলে, সেই সঙ্গে মা আর ছোট বোনটা। শোভনের দুই মেয়ে কাণ্ড করল আরও বেশি বাইরের ঘরে শোভন আর নীলু শুয়েছিল–ঘুমোতে পারল না। সাধন ছাড়া ভাইয়েরা যে যার আগে খেয়ে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে কি আস্তানায় কেটে পড়েছিল, তবু যজ্ঞিবাড়ির ভিড়ের মতো হয়ে রইল রবিবারের দুপুর।
সবার শেষে খেতে এল সাধন। মিষ্টি মুখের ডৌলটুকু আর গায়ের ফর্সা রং রোদে পুড়ে তেতে কেমন টেনে গেছে। মেঝেতে ছক পেতে বাইরের ঘরেই লুডো খেলছিল বল্লরী, মামী, আর নীলুর দুই বোন সাধন ঘরে ঢুকতেই নীলু বল্লরীর মুখখানা লক্ষ করল।
যা ভেবেছিল তা হল না। বল্লরী চিনতেও পারল না সাধনকে। মুখ তুলে দেখল একটু, তারপর চালুনির ভিতর ছক্কাটাকে খটাখট পেড়ে দান ফেলল। সাধনও চিনল না।