প্রথম ওভারেই ঢোলাকিয়ার হাতে বল। সারামাঠ নিশ্চপ। একজন অঙ্কের অধ্যাপক অ-ক্রিকেটার কী করতে পারে জানার জন্য সমস্ত পৃথিবীই দমবন্ধ করে বসে আছে। অরুণ ঢোলাকিয়া কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। তারপর শুরু করল দৌড়।
প্রথম বলটা লুপ। স্টাম্পের সোজা পিচে পড়ে, বাঁ-দিকে বেঁকে গেল, ব্যাটসম্যানের বাড়ানো ব্যাটকে এড়িয়ে, ফের ডানদিকে ঘুরল, না, স্টাম্পে লাগল না। একটু উঁচু দিয়ে চলে গেল উইকেটকিপারের হাতে। ঢোলাকিয়া বিরক্ত। ক্যালকুলেশনের সামান্য ভুল।
দ্বিতীয় বলটা আবার লুপ। কিন্তু ধীর গতির ব্যাটসম্যান মরিস বলটাকে তার সিনথেটিক ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে দিল কভারে, চার।
আজকাল মাঠে কোনো আম্পায়ার থাকে না। কিন্তু মাঠের চারদিকে অজস্র বৈদ্যুতিন চোখ। স্কোরবোর্ড নির্দেশ দিল চারের।
তৃতীয় বলটা করার আগে ফের একটু ধ্যানস্থ হল সে। ধীরে দৌড়ে এসে বল করল। মরিস ব্যাটটা তুলল কিন্তু সময়মতো নামাতে পারল না। মাটি কামড়ে বলটা গিয়ে তার মিডলস্টাম্প উপড়ে দিল, শুটার।
ওভার যখন শেষ হল, তখন স্কোরবোর্ড-এ চার রানে চার উইকেট। হ্যাট্রিকসহ। দলের অন্য খেলোয়াড়রা এতদিন অ-ক্রিকেটার ঢোলাকিয়াকে পাত্তা দিচ্ছিল না। কিন্তু ওভার শেষ হলে, কেউ কেউ এসে তার পিঠ চাপড়ে গেল।
খেলা অবশ্য বেশিক্ষণ গড়াল না। মোট বাইশ রানে প্রতিপক্ষ অল আউট। ঢোলাকিয়ার ঝুলিতে দশ ইউকেট। সতীর্থদের কাঁধে চড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরল ঢোলাকিয়া।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তাতে অবশ্য খেলা আটকায় না আজকাল। দুশো মিটার ওপরে অন্যদিক থেকে দশটা পদ্মফুলের পাপড়ির মতো স্বচ্ছ ঢাকনা এসে গোটা মাঠ ঢাকা দিয়ে দিল।
এক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত জিতে গেল ম্যাচ। জনতা গর্জন করে উঠল। ঢোলাকিয়া জিন্দাবাদ। সমগ্র পৃথিবী স্তম্ভিত। এ কী আশ্চর্য বোলিং! পরদিন পত্রপত্রিকা আর ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে কেউ কেউ দাবি করল ঢোলাকিয়া চাক করছে, ওকে নো বল ডাকা উচিত।
দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যাণ্ড, তৃতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া একে একে উড়ে যেতে লাগল। ফাইনালে শোচনীয়ভাবে হারল দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইণ্ডিজ। তারা পনেরো রানে অল আউট।
বিশ্বকাপের উত্তেজনার পর তার নির্জন বাড়িতে ফিরে এল ঢোলাকিয়া। এত উত্তেজনা, এত চেঁচামেচি ও শোরগোল ইত্যাদিতে সে বড়ো অস্বস্তিতে ছিল। নিরিবিলিতে এসে, সে খুব শান্তি পেল। তার কাজ শেষ। পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তার কলাকৌশল আর গোপন রাখা যাবে না। অন্যেরা কপি করে নেবে। তা নিক, লুপ আর শুটার নিয়ে বিস্তর গবেষণা হবে। বদল করা হবে বল, তাতে আর কিছু আসে যায় না অরুণ ঢোলাকিয়ার, সে তার অঙ্ক নিয়ে থাকবে।
অস্বস্তিটা শুরু হল তৃতীয় দিন থেকে। অধ্যাপক অরুণ ঢোলাকিয়ার খুব একা লাগছে। বড্ড একা, তার সময়। কাটতে চাইছে না। প্রচুর অভিনন্দন জানিয়ে লোকে ফোন করছে, উপহার পাঠাচ্ছে, অনেকে চলেও আসছে তাকে দেখতে, পৃথিবীজুড়ে তাকে নিয়ে আলোচনা। এ-সবই তার কাছে বিরক্তিকর এবং অস্বস্তিকর।
কয়েকদিনের জন্য সে সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে এল। কিন্তু সারাক্ষণ একটা নিঃসঙ্গতা সঙ্গে রয়েছে তার। প্রিয় অঙ্কশাস্ত্রও যেন আলুনি লাগছে আজকাল। কেন এমনটা হচ্ছে? সারাক্ষণ একটা অস্থিরতা বোধ করছে সে।
একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে নিজেকেই সে প্রশ্নটা করল, এমন লাগছে কেন? কেন এমন লাগছে?
কোনো জবাব খুঁজে পেল না সে।
রামনাথ ফোন করল দশদিন বাদে, অভিনন্দন জানাচ্ছি। তুমি আমাকে ধাপ্পা দিয়েছিলে বলে, গত দশদিন ফোন করিনি। আমার অভিমান আর রাগ হয়েছিল, সেটা সামলে উঠেছি।
রামনাথের গলা শুনেই কেন যে বুকটা হঠাৎ এমন দুরুদুরু করতে লাগল কে জানে! ধরা গলায় অরুণ ঢোলাকিয়া বলল, অনেক ধন্যবাদ।
ফোন রেখে অনেকক্ষণ ভাবল অরুণ, রজনিরও কি উচিত ছিল-না, একবার ফোন করা বা অভিনন্দন জানানো? অদ্ভুত তো মেয়েটা! খুব রাগ হল অরুণের। কেন জানাল না? কেন এত দেমাক ওর! কেন ওর এত অবহেলা তাকে? তার যে ভীষণ রাগ হচ্ছে। রাগে যে জ্বলে যাচ্ছে গা। অসহ্য। অসহ্য।
আরও দু-দিন সময় দিল সে, তারপর আরও তিনদিন, নাঃ এ তো সহ্য করা যাচ্ছে না! কিছুতেই না।
সাতদিনের দিন এক সকালবেলা, সে রজনির মোবাইল ফোনের নম্বর বের করল কম্পিউটার সেন্টারে ফোন করে।
রজনির মিহি হ্যালো শুনেই রাগে ফেটে পড়ল অধ্যাপক অরুণ ঢোলাকিয়া, কী–কী ভেবেছ তুমি! অ্যাঁ! কী ভেবেছ? আমাকে এত অবহেলা করার মানে কী আমি জানতে চাই…
এই তীব্র রাগের জবাবে মেয়েটা তাকে অবাক করে দিয়ে খিলখিল করে হাসল। তারপর বলল, হ্যাঁ!
হ্যাঁ! হ্যাঁ মানে কী?
হ্যাঁ মানে হ্যাঁ।
অরুণ একটু লাল হল লজ্জায়। তারপর বলল, ও, তাহলে হ্যাঁ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।