সেই সূত্রপাত, রামনাথই তাকে ক্রিকেট বুঝিয়েছিল এবং আগ্রহী করে তুলেছিল। মাসতিনেক ধরে সে নোভা বল নিয়ে মেতে আছে। আজ নিজের সাফল্য সম্পর্কে সে ঘোর আত্মবিশ্বাসী। ভারতীয় নির্বাচকমন্ডলী তার মতো নামি লোকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারছে না, তাকে হয়তো দলে নেওয়া হবে। এরজন্য বৃদ্ধ। রামনাথের কাছে সে কৃতজ্ঞ। কিন্তু মুশকিল হল বলের গায়ে ডোন্ট কথাটা লিখে রজনি কী বোঝাতে চাইছে? তাহলে কি মাঠে ও আশপাশে বা ঊর্ধ্বাকাশে গুপ্তচর রয়েছে? তার বোলিং অ্যাকশন কি রেকর্ড করা হবে?
অরুণ ঢোলাকিয়া ফুটফুটে মেয়েটার দিকে বার বার তাকাল, কিন্তু মেয়েটা একবারও তার দিকে তাকাল না। উদাসীন মুখে ঘাসের ওপর বসে নিজের নখ দেখছে এখন।
ঢোলাকিয়া বিদ্যুৎবেগে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল। বৃদ্ধ রামনাথকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
সুতরাং অরুণ যে ছ-টা বল করল, তার একটাও গড়িয়ে গেল না। একটাও লুপ হল না।
উত্তেজিত রামনাথ মাথা নেড়ে বলল, পিচে জায়গামতো পড়ছে না।
তাই তো দেখছি, মনে হচ্ছে শুটার বা লুপ আমাদের কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
রামনাথ রাই প্রচন্ড হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, তাহলে তোমার পরিশ্রম বৃথাই গেল?
তাই মনে হচ্ছে।
আবার চেষ্টা করে দ্যাখো, নোভা বলের ভেতরে এক ধরনের সিনথেটিক আঠা থাকে। তার ফলে বলটা ক্যাট বলের চেয়ে একটু বেশি লাফায়। মুশকিল কি সেখানেই হচ্ছে?
ঢোলাকিয়া জানে, সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা রামনাথ নিজেই। অরুণ সেটা রামনাথকে বলে কী করে?
তবে সে আর এক ওভার বল করল, ইচ্ছে করে প্রথম পাঁচটা বল করল বিশ্রীভাবে। কিন্তু ষষ্ঠ বলটা করল। তার ক্ষুরধার ক্যালকুলেশন দিয়ে। বলটা নীচে পড়ে মাটি কামড়ে বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে মিডল স্টাম্প ছিটকে দিল।
বাঃ, এই তো হচ্ছে? বলে চেঁচিয়ে উঠল রামনাথ।
রজনি হঠাৎ উঠে তাঁবুর দিকে হাঁটতে লাগল, ঢোলাকিয়া ভাবল সে কোনো মারাত্মক ভুল করে বসল নাকি? তবে বুদ্ধি করে সে ডান হাতের গ্রিপ বাঁ-হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। এবং শুধু গ্রিপ ছাড়াও অনেক ব্যাপার আছে যা, নকল করা সহজ নয়, বিশেষ এক গতিতে, বিশেষ এক কোণ থেকে ডায়াগোনাল রান আপ নিয়ে আসতে হবে। ডেলিভারির সময়ে গোটা হাতেরও একটা বিশেষ কম্পন চাই, এসব সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় অনুধাবন ও অনুশীলন সোজা কথা নয়। তবু মনটার খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল।
রামনাথ তাকে আরও বল করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল, কিন্তু অরুণ রাজি হল না, টেলিফোনে একটা হেলি-ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে বাড়ি ফিরল।
একটু রাতের দিকে ফোনটা এল।
আমি রজনি।
ওঃ, রামনাথবাবুর ছোট্ট মেয়েটা?
হ্যাঁ। আপনি আজ খুব ভুল করেছেন, বলের ওপর আমি লিখে রেখেছিলাম ডোন্ট।
হ্যাঁ, দেখেছি।
তা সত্ত্বেও শেষ বলটা ওরকম করলেন কেন?
না-করলে, তোমার বাবা হতাশ হতেন।
তাহলেও ক্ষতি ছিল না, আজ মাঠের চারপাশে লোক ছিল, আপনি তাদের দেখেননি, কিন্তু আমি জানি, দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞরা আপনার অ্যাকশনের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। আপনি আমার বারণ শুনলেন না কেন?
আমার ভুল হয়েছে। আসলে তুমি একটি বাচ্চা মেয়ে বলে, তোমার বারণকে বেশি গুরুত্ব দিইনি।
আমার বয়স চোদ্দো, আজকাল এ-বয়সের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞরা জানল কী করে?
আমার বাবাই জানিয়েছে। চল্লিশ বছর আগে বাবাকে ভারতীয় টিম থেকে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হয়। এটা তারই প্রতিশোধ।
কিন্তু উনিই তো আমাকে এ-কাজে নামিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, কারণ তিনি জানেন, আপনার মতো একজন ধুরন্ধর অঙ্কবিদকে দিয়েই কাজটা সম্ভব। আমার বাবাও একজন ম্যাথমেটিশিয়ান, কৌশলটা আপনাকে দিয়ে আবিষ্কার করিয়ে, সেটা অন্য দেশকে বেচে দেওয়ার মতলব ছিল তাঁর।
এখন তাহলে কী হবে?
সেটা আপনিই ঠিক করুন। আর এক মাস পরেই বিশ্বকাপ। দু-হাজার নিরানব্বই সালের সতেরোই ডিসেম্বর। প্রথম ম্যাচেই ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ আফ্রিকা, আপনি কতবড়ো ভুল করেছেন আজ তা বুঝতে পারছেন?
পারছি রজনি, আমার এতদিনের পরিশ্রম বৃথা গেলে আমি খুবই ভেঙে পড়ব।
এখন মন দিয়ে শুনুন।
বলো।
আপনি আমার বারণ শুনবেন না বলে ধরে নিয়ে, আমি একটা কাজ করেছি। কী কাজ? পিচের সোজাসুজি যে দুটি বাতিস্তম্ভ ছিল, আমরা সে দুটি থেকে বিমার রশ্মি ফেলেছিলাম। যতদূর জানি এই রশ্মি ফেললে ক্যামেরার চোখ ঝলসে যায়, মানুষের চোখে কিছু ধরা পড়ে না।
সত্যি?
হ্যাঁ, আমি এবং আমার বান্ধবীরা বুদ্ধি করে এইটে করেছি। তাতে কতদূর কাজ হবে, তা আমরা জানি না। ওদের কাছে হয়তো আরও অত্যাধুনিক ক্যামেরা আছে।
সেটা থাকাই সম্ভব।
আমি যে-বলটা আপনাকে দিয়েছিলাম তাতেও একটা সলিউশন মাখানো ছিল। তাতে মুভমেন্টের সময় হাওয়া লাগলে, সেলাইগুলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে। জানি না, এতে কতটা কাজ হবে। কিন্তু আমরা। আমাদের সাধ্যমতো করেছি।
তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব?
বিশ্বকাপটা জিতুন, তাহলেই হবে।
.
বিশ্বকাপের শুরুতেই সারাপৃথিবীতে তুমুল আলোচনা, ভারত তাদের দলে একজন নন-ক্রিকেটার অঙ্কবিদকে খেলাচ্ছে। হাসাহাসি, ঠাট্টা, মশকরা, সমালোচনা, প্রতিবাদ সবই হতে লাগল। তার মধ্যেই কলকাতার ইডেন উদ্যানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলতে নামল ভারত। টসে জিতে ভারতের অধিনায়ক নানক দাশগুপ্ত প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে পাঠাল ঢোলাকিয়ার পরামর্শে।