স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এল অরুণ ঢোলাকিয়া। এখানে কিছু রেস্তোরাঁ এবং দোকানপাট। কিছু মানুষজন দেখা যাচ্ছে। তবু খুব-ই ফাঁকা। এখানেই লোকটার আসার কথা।
অরুণ চারদিকে চেয়ে সবুজদ্বীপ রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল। খুবই ছোটো রেস্তোরাঁ। সব মিলিয়ে দশটা টেবিল পাতা আছে। খুবই কম আলোয় দেখা গেল, খদ্দের নেই বললেই হয়। একটা টেবিলে চারজনের একটি পরিবার বসে খাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী এবং দুটি বাচ্চা। আর কোণের দিকে একজন লোক চুপচাপ বসে আছে।
ঢোলাকিয়া সেদিকেই এগিয়ে গেল।
নমস্কার।
লোকটা মুখ তুলে একটু হাসল, বোসো ঢোলাকিয়া।
সে বলল, কী খাওয়া যায় বলো তো?
যা খুশি। তবে আমি নিরামিষাশী।
সে তো আমিও। ভেজিটেরিয়ানদের সংখ্যাই তো বেশি।
নুডলসের অর্ডার দিয়ে লোকটি পকেট থেকে একটা খুদে টেলিভিশন সেট বের করে ঢোলাকিয়ার হাতে দিয়ে বলল, ওতে চার মিনিটের একটা কভারেজ আছে দেখে নাও।
ছোটো টিভি সেটটার মধ্যেই ভিডিয়ো টেপ রয়েছে। ঢোলাকিয়া সেটটা অন করল। একটা ক্রিকেট মাঠ। একজন ব্যাটসম্যান দাঁড়িয়ে। একজন বল করতে দৌড়োচ্ছে। বল করল, পিচে পড়ে বলটা নীচু হয়ে গেল। খুব নীচু। ব্যাটসম্যান সেটাকে আটকে দিল। দ্বিতীয় বলটা নীচু হল না, কিন্তু অফস্টাম্পে পড়ে বাঁই করে ঘুরে স্টাম্পের দিকে এল। ব্যাটসম্যান বিপজ্জনক বলটাকে ফের আটকাল। দেখতে দেখতে ঢোলাকিয়া বলল, এ বল-এ আজকাল খেলা হয় না।
জানি। নতুন নোভা বলে ক্রিসক্রস সেলাই থাকে।
হ্যাঁ।
তুমি যে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছ তাতে নোভা বল হয়তো সাহায্য করবে। কিন্তু মনে রেখো, পঞ্চাশ বছর আগে পুরোনো ক্যাট বলেও এরকম সেলাই থাকত।
জানি। আমার কাছে পুরোনো সবরকম বলেরই নমুনা আছে।
পরের বলটা–আশ্চর্যের বিষয়–পিচে পড়েই সম্পূর্ণ গড়িয়ে স্টাম্পের দিকে গেল। ব্যাটসম্যান আটকাতে পারল না। বোল্ড।
লোকটা একটু হেসে বলল, দেখলে?
ঢোলাকিয়া মাথা নেড়ে বলল, দেখলাম, আপনি চল্লিশ বছর আগে শুটারস দিতেন।
হ্যাঁ, সারা পৃথিবীতে আমিই একমাত্র শুটারস আর লপ বল করতে পারতাম। তবে ছ-টা বলের মধ্যে একটা দুটো বা তারও কম। ডেলিভারির ওপর কন্ট্রোল সহজে আসে না। কঠোর অনুশীলন দরকার, কেরিয়ারের শেষদিকে আমি কৌশলটা খানিক রপ্ত করতে পেরেছিলাম, কিন্তু পুরোটা নয়। আজ অবধি কৌশলটা কাউকে শেখাইনি।
ঢোলাকিয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে খাবার খেয়ে গেল, তারপর বলল, কাল ওরা আমার পরীক্ষা নেবে।
লোকটা একটু হাসল, মুখ না তুলেই বলল, ঈশ্বর তোমার সহায় হোন। যদি ওরা তোমাকে টিমে নেয়, তাহলে এই প্রথম একজন নন-ক্রিকেটার টিমে ঢুকবে।
হ্যাঁ, আমি ওদের বুঝিয়েছি যে, আমি ক্রিকেটার না, হলেও, একজন বিশেষজ্ঞ।
লোকটা সকৌতুকে একটু চেয়ে মাথা নাড়ল।
খাওয়া শেষ করে লোকটা বলল, এবার চলো, হাতে-কলমে ব্যাপারটা দেখা যাক।
বাইরে পার্কিং লটে লোকটার ছোটো হেলি-কারে এসে উঠল তারা। এ গাড়ি মাটি দিয়ে চলে না, হুশ করে। হাওয়ায় ভেসে পড়ে। দ্রুত গতি, ব্যাটারিচালিত মোটর পাখির ডানার মতো দুটি ফ্লোটারকে চালু রাখে, পাখির মতোই স্বচ্ছন্দে ওড়ে এই গাড়ি। দশ মিনিটের মধ্যেই তারা নিরিবিলি শরতলির একটা উজ্জ্বল আলোয় সজ্জিত মাঠে এসে নামল। মাঠের মাঝখানে বাইশ গজে ক্রিকেট পিচ। চারদিকে আলোর স্তম্ভ জায়গাটাকে দিনের। অধিক আলোকিত করে রেখেছে।
লোকটা অনুচ্চ স্বরে ডাকল, রজনি?
মাঠের ধারে একটা ছোটো তাঁবুর ভেতর থেকে একটি কিশোরী মেয়ে ঘুমচোখে বেরিয়ে এসে হাই তুলল। লোকটা বলল, আমার ছোটোমেয়ে রজনি। ও যদি ছেলে হত, তবে ওকে আমার সব বিদ্যে শেখাতাম। আমার ছেলে নেই, চারটিই মেয়ে।
মেয়েরাও তো ক্রিকেট খেলে।
খেলে, আমার মেয়েরা ক্রিকেটে আগ্রহী নয়। মেয়েটা পিচের একধারে নিঃশব্দে তিনটে স্ট্যাম্প পুঁতে দিয়ে সরে দাঁড়াল, তারপর বলল, ইনিই কি তিনি?
লোকটা বলল, হ্যাঁ, আমাদের তুরুপের তাস, এসো ঢোলাকিয়া, বল করো।
রজনি একটা ব্যাগ থেকে সাদা রঙের একটা বল বের করে অরুণ ঢোলাকিয়ার দিকে ছুঁড়ে দিল। এই সেই বিতর্কিত বল নোভা, বলটাকে যদি পৃথিবী হিসেবে ধরা যায় তাহলে এর একটা সেলাই গেছে বিষুবরেখা বরাবর, অন্যটা দুই মেরু ভেদ করে, বলের দু-পিঠে এক জায়গায় সেলাই দুটো কাটাকাটি করেছে আর এই দুটো জায়গাই অরুণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল অরুণ। নজরে পড়ল দুটো সেলাই যেখানে কাটাকাটি করেছে সেখানে হালকা পেনসিল দিয়ে চারটি অক্ষর–ডি ও এন টি, ভ্রূ কুঁচকে ঢোলাকিয়া একটু ভাবল, এর মানে কি ডোন্ট? সে মেয়েটার দিকে এক ঝলক তাকাল, মেয়েটা খুব বিরক্তি মাখানো মুখে অন্যদিকে চেয়ে আছে।
বৃদ্ধ রামনাথ রাই তার দিকে মিটমিটে চোখে লক্ষ রাখছে। রামনাথ ষাট সত্তরের দশকে ভারতীয় একাদশে খেলেছিল। তার রেকর্ড তেমন ভালো কিছু নয়, কিন্তু অরুণের মাথায় আইডিয়াটা ঢুকিয়েছিল এই লোকটাই, অঙ্কের জগতে অরুণ ঢোলাকিয়ার খ্যাতি সাংঘাতিক। বিশেষ করে জ্যামিতিক এবং ত্রিকোণমিতিক গণনায় সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার রৈখিক গণনায় সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার রৈখিক গণনা, বিচার ও বিশ্লেষণ পৃথিবীর যেকোনো বিষয়েই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বৃদ্ধ রামনাথ একদিন তার দ্বারস্থ হয়ে বলল, বাপু, ক্রিকেটের জন্য তুমি কিছু করো।