ঢোলাকিয়া তার বাড়িটাকে শীততাপনিয়ন্ত্রিতও করেনি। ঠাকুরদার আমলের পুরোনো ঘরানার বাড়িতে সে যেন বিংশ শতাব্দীকে ধরে রেখেছে।
ঢোলাকিয়া আজ কিছু চঞ্চল, উন্মন। সে তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে বাড়ির বিভিন্ন ঘরে উদভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। নিজেকে শান্ত করা দরকার। বেশি আনন্দ বা বেশি দুঃখ কোনোটাই ভালো নয়।
ঢোলাকিয়ার বাড়িতে জনমনিয্যি নেই। এমনকী কুকুর, বেড়ালটা অবধি নয়। ঢোলাকিয়া বিয়ে করেনি, মা বাবা থাকে গাঁয়ের বাড়িতে। ঢোলাকিয়াকে সবাই অসামাজিক মানুষ বলেই মনে করে। আসলে সামাজিক হতে গেলে কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা এবং গবেষণার সময় অত্যন্ত কম পাওয়া যায়। সে একাই বেশ থাকে। অবশ্য সে জানে, একা বেশিদিন থাকা চলবে না। এই সোনালি দিনের আয়ু বেশি নয়। কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করাটা বাধ্যতামূলক। এবং সন্তান উৎপাদনও। দু-হাজার থেকে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, দুরারোগ্য ক্যান্সার আর এইডস, মারাত্মক ভূমিকম্প, বিশ্বযুদ্ধ ও ঘূর্ণিবাত্যায় পৃথিবীতে বিপুল লোকক্ষয়ের পরিণামে এখন জনসংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কম। সারা ভারতবর্ষে জনসংখ্যা এখন এক কোটি তিপ্পান্ন লক্ষ মাত্র। এবং ভারতের জনসংখ্যাই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। চিনে আড়াই কোটি মানুষ বেঁচে-বর্তে আছে। গোটা ইউরোপে আছে দু-কোটির সামান্য বেশি। আমেরিকায় মোট পঞ্চান্ন লক্ষ। আফ্রিকায় তিন কোটি দশ লক্ষ। বিপদের কথা হল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি বাড়ছে না। বরং কমছে। ফলে কাউকেই অবিবাহিত থাকতে দেওয়া হয় না। সন্তান উৎপাদনও করতেই হবে। কিন্তু অরুণ ঢোলাকিয়ার দুশ্চিন্তাই হল বিবাহিত জীবন। একটা মেয়ের সঙ্গে বাস করতে হবে, তার ওপর ছেলেপুলের চ্যাঁ ভ্যাঁ–এসব কি সহ্য হবে তার?
একটা কুশনের ওপর বসে কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হল সে। মনকে শান্ত ও সজীব রাখার এটাই প্রকৃষ্ট উপায়।
স্যাটেলাইট টেলিফোনটা সংকেত দিল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে অরুণ ঢোলাকিয়া বলল, বলুন।
ক্রীড়া দফতর থেকে অবিনশ্বর সেন বলছি। আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।
ভালো কথা। কিন্তু এখনও আপনার বিপক্ষ গোষ্ঠী ব্যাপারটা মানতে চাইছে না।
তারা কি বার বার একটা আপত্তিই জানাচ্ছেন? নাকি নতুন কোনো পয়েন্ট বের করেছেন?
না, নতুন পয়েন্ট নয়। তারা সেই পুরোনো কথাই আরও জোর দিয়ে বলছেন, কোনো অ-খেলোয়াড়কে দলভুক্ত করা যায় না।
আমি তো বলেইছি, আমি খেলোয়াড় নই বটে, কিন্তু আমি একজন বিশেষজ্ঞ। আমার পারফরম্যান্স হবে সম্পূর্ণ ম্যাথমেটিক্যাল ক্যালকুলেশনের ওপর।
ওদের ওখানেই আপত্তি। চূড়ান্ত দলে আপনাকে জায়গা দিতে হলে একজন দক্ষ খেলোয়াড়কে বাদ দিতে হয়। যেক্ষেত্রে আমরা চাপে থাকব।
সেনবাবু, আপনাদের মানসিকতা পিছিয়ে আছে। এমন একদিন আসতে বাধ্য যখন খেলোয়াড় এবং বিশেষজ্ঞ এ-দুটোই দরকার হবে। একথা ঠিক যে আমি ক্রিকেট খুব বেশি বুঝি না, ব্যাট করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু আমি যা করতে পারি, তা আপনাদের টিমে কেউ পারবে না।
সেটাও পরীক্ষাসাপেক্ষ। আপনি কবে ডেমনস্ট্রেশন দিতে পারবেন?
আপনারা অর্থাৎ নির্বাচকমন্ডলীর সবাই যদি উপস্থিত থাকেন তবে আগামীকালই আমি ডেমনস্ট্রেশন দিতে পারি। কিন্তু দোহাই, একবারের বেশি দু-বার পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়।
কেন?
আমার কলাকৌশল বেশি লোকের কাছে এক্সপোজ করা ঠিক হবে না। আমি কৌশলটা একেবারে বিশ্বকাপের আসরেই প্রয়োগ করতে চাই।
খুব মুশকিলে ফেললেন।
আর একটা কথা।
কী?
আমার অ্যাকশনের কোনো ভিডিয়ো তোলা চলবে না। কোনো ক্যামেরা বা রেকর্ডারও নয়।
আপনি বড্ড বেশি দাবি করছেন।
করছি, কারণ আমি একাই ভারতকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেব বলে মনে করছি।
নির্বাচকরা এটাই মানতে চাইছেন না। যাই হোক, আপনি কাল সকাল দশটায় ক্রীড়াকেন্দ্রে চলে আসুন।
ফোনটা পকেটে রেখে অরুণ ঢোলাকিয়া উঠে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। কলকাতা শহরে আজকাল মাত্র বত্রিশ হাজার লোক বাস করে। একসময়ে এখানে এক কোটি মানুষ বাস করত। তখনও শহরটা ছিল ঘিঞ্জি, নোংরা, ভিড়াক্কার, এখন শহর গাছপালায় ভরতি। চওড়া রাস্তার দুধারে বড়ো বড়ো গাছের সারি, প্রচুর বাগান, পার্ক, জলাশয়। এসবের-ই ফাঁকে ফাঁকে অনেক দূরে দূরে একখানা করে বাড়ি।
এবার প্রচন্ড শীত পড়েছে। গতকালও দু-ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। অরুণ ঢোলাকিয়ার গায়ে পশমের জামা আছে, তা সত্ত্বেও তার শীত করছিল। একটু হাঁটাচলা না করলে মাথার জটটা খুলবে না।
মাইলখানেক হাঁটল অরুণ, একজন মানুষের সঙ্গেও দেখা হল না। দুটো ওভারক্র্যাফট নিঃশব্দে রাস্তা দিয়ে গেল।
আঞ্চলিক বাজার নামে কথিত একটা করে বহুমুখী কেন্দ্র শহরের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছে। এগুলো আসলে বাজার, ক্লাব, রেস্তোরাঁ ইত্যাদির সমাবেশ।
ঢুকতেই একটা হলঘর। মাঝখানে বিশাল এক ফোয়ারা, তার চারপাশে চমৎকার বসার জায়গা। দুঃখের বিষয় বসবার লোক নেই। হলঘরের মধ্যে রয়েছে বিস্তর গাছপালা এবং সবুজ লনও। ছাদটা স্বচ্ছ আবরণে তৈরি বলে এই ঘরে সূর্যের আলো আসতে পারে। হলঘরের চারদিকে ছোটো ছোটো থিয়েটার এবং ভিডিয়ো হল। টিকিট কাটতে হয় না, থিয়েটার এমনিই দেখা যায়। তবে নাটক করার মতো দল বেশি নেই বলে থিয়েটারগুলো বেশির ভাগই অচল থাকে। ভিডিয়ো হলেও লোক হয় না।