বেড়ালটাকে তেড়ে গেলেন না সুধন্য। গিয়ে লাভ কী? বেড়ালের মুখের মাছ তো হেমন্তবালা আর হেঁশেলে তুলবে না, খাচ্ছে খাক।
হেমন্তবালার চিক্কার শোনা গেল একটু বাদেই, চোখের পলকে দু-দুটো মাছ হাওয়া হয়ে গেল। বুঁচির বাপ কি একটু চোখে-চোখেও রাখতে পারে না বাড়িঘর, না কি! কোথায় গেল লোকটা, অ্যাঁ?
নস্যির ডিবেটা এখনও পাওয়া যায়নি। সুধন্যর খুব অস্বস্তি হচ্ছে। বুঁচিটা বাড়ি ফিরলে ওর মায়ের হাতে আজ খুব পেটান খাবে।
দুপুরের কলকাতা যাওয়ার ট্রেনটা এসে স্টেশনে ঢুকল। সামনের মাঠ ভেঙে দুজন ধুতিপরা লোক গাড়ি ধরতে দৌড়োচ্ছ। চমৎকার দৌড়, কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন সুধন্য। পাবে কি? না, পাবে। স্টেশনের হাতায় প্রায় পৌঁছে গেছে। ঘন্টি বাজল, গার্ড হুইশল দিল, ইঞ্জিন কু দিল, সব। নিয়ম মাফিক। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছেন, ঠিক একইভাবে ট্রেন ছাড়ে। লোক দুটোর একজন সিগন্যালের তারে হোঁচট খেয়ে পড়তে-পড়তে সামলে গেল। সুধন্য হাঁ করে চেয়ে আছেন।
শেফালির গলা পেলেন–বাবা!
উত্তর দিলেন না, দেখছেন। না, পেয়ে গেল। ওই প্রথম লোকটা উঠে পড়েছে কামরায়। উঠে হাত বুলিয়ে দ্বিতীয় লোকটাকে চলন্ত গাড়িতে তুলে নিল টেনে।
বাঁচা গেল।
—বাবা! হাঁ করে দেখছ কী?
—উঁ!
মনটা ভালো নেই। কেন যে বুঁচিটা তেঁতুল চুরি করতে গেল! আজ দুপুরে খাওয়ার সময়ে ফিরে এলে খুব মার খাবে মেয়েটা। ছোট মেয়েটা যতই দামাল দুষ্টু হোক, ওর কান্না শুনলে সুধন্যর বুকটা কেমন করে যেন। ওটার ওপর তাঁর বড় মায়া। ছোট মেয়েটা।
–কী দেখছিলে? শেফালি জিগ্যেস করে ফের।
—দুটো লোক দৌড়ে ট্রেন ধরল, তাই দেখলাম। আজকাল আর দেখার আছেটা কী? যা চোখে পড়ে দেখি।
শেফালি এমনিতে শান্ত মেয়ে। কিন্তু খুব জেদি। রাগিও। তা ছাড়া বাপকে বাপ বলে বিশেষ গ্রাহ্য করে না। বেশি আদর দিলে যা হয়। যারা আদর দেয় তাদের ওজন কমে যায় এদের। কাছে।
শেফালি বিরক্ত হয়ে বলল শোনো, আমাদের বায়োসায়েন্স থেকে মহারাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে স্পেসিমেন কালেকশনে। প্রায় কুড়িজনের টিম যাবে।
—ও।
–কলেজ একটা গ্র্যান্ট দিচ্ছে, যাতায়াতের ভাড়া ওরাই দেবে। থাকাখাওয়ার খরচ আমাদের। পার হেড দেড়শো টাকার মতো লাগবে।
—ও। আমাকে সিলেক্ট করেছে।
সুধন্য চুপ করে থাকেন, শোনেন হেমন্তবালা বেড়ালের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করছেন, সেই সঙ্গে বুঁচি আর সুধন্যকেও।
–টাকাটা দেবে বাবা?
–টাকা!
–টাকা মোটে দেড়শো। আচ্ছা, না হয় তুমি আরও কম দিও। একশোতেই আমি চালিয়ে নেব। একটা জায়গায় ঘোরাও হবে।
সুধন্য শ্বাস ফেলেন। দেবেন বইকী! না দিয়ে যাবেন কোথায়! বরাবর দিয়ে আসছেন। বুঁচিটা বড্ড মার খাবে আজ। বেড়ালটা দুটো মাছ নিয়ে গেল, মোট পাঁচটার মধ্যে দুটো। শেফালি একশো টাকার ধাক্কায় ফেলে দিল। বাড়িটায় কত টাকা আটকে আছে। ছেলেও নেই যে ভোগ করবে। কী লম্বা ছুটি চলছে রে বাবা!
নস্যির ডিবেটা কখন কীভাবে হাতে এসে গেল কে জানে! ঠিক ম্যাজিশিয়ানের মতো, কোথাও কিছু না, হঠাৎ হাতে চেয়ে দেখেন, নস্যির ডিবেটা হাসছে।
বড় খুশি হন সুধন্য। ভগবান মঙ্গলময়। সুধন্য পৃথিবী ভুলে নস্যির ডিবের মুখে টোকা মারেন। খুব জোর একটা টিপ নেবেন।
হ্যাঁ
অধ্যাপক ঢোলাকিয়া অবশেষে এক জানুয়ারির শীতার্ত রাতে তার টেবিল ছেড়ে উঠল। টেবিলের ওপর অজস্র কাগজপত্র ছড়ানো, তাতে বিস্তর আঁকিবুকি এবং অসংখ্য অঙ্ক। এত অঙ্ক ও আঁকিবুকির সমুদ্র থেকে একটি মাত্র কাগজ তুলে নিল ঢোলাকিয়া, ভাঁজ করে কোটের বুক-পকেটে রাখল। গত সাতদিন ঢোলাকিয়া জীবন রক্ষার্থে সামান্য আহার্য গ্রহণ করা ছাড়া ভালো করে খায়নি, ভালো করে ঘুমোয়নি, বিশ্রাম নেয়নি। এখন সে একটু অবসন্ন বোধ করছিল, কিন্তু মনটা খুশিতে ভরা। মনে হচ্ছে সে কৌশলটা আবিষ্কার করতে পেরেছে।
ঢোলাকিয়াকে লোকে বলে অযান্ত্রিক মানুষ। এই কম্পিউটার এবং ক্যালকুলেটরের যুগে ঢোলাকিয়া পড়ে আছে দেড়শো বছর পেছনে। সে এখনও কাগজে কলম দিয়ে আঁক কযে, রেখাচিত্র আঁকে। পৃথিবীর যত শক্ত অঙ্ক আর রেখাচিত্র, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেব-নিকেশ যখন যন্ত্রই করে দিচ্ছে তখন মানুষ কেন অযথা পরিশ্রম করবে? ঢোলাকিয়ার বক্তব্য হল, অঙ্ক আমার কাছে আর্ট, লাইন ড্রয়িং-এ আমি সৃষ্টিশীলতার আনন্দ পাই। যন্ত্র তো মানুষের মস্তিষ্কেরই নকল। যন্ত্র আর্ট বোঝে না, সৃষ্টিশীলতাও তার নেই। প্রোগ্রাম করা যান্ত্রিকতা আমার পথ নয়।
ঢোলাকিয়ার মতো আরও কিছু মানুষও আজকাল কম্পিউটারের চেয়ে কাগজ কলম বেশি পছন্দ করে। সংখ্যায় মুষ্টিমেয় হলেও এ-ধরনের কিছু মানুষের ইদানীং যে উদ্ভব হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ঢোলাকিয়া তার বাড়িটাকে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সাজায়নি। আজকাল বোতাম টিপলেই ঘরের আকার ও আকৃতি বদলে নেওয়া যায়। কম্পিউটারে নানারকম নকশা দেওয়াই থাকে। সেসব নকশার নম্বর ধরে বিভিন্ন বোতামের সাহায্যে ওপর থেকে বা আড়াআড়ি নানাধরনের হালকা ভাঁজ করা দেওয়াল এসে ঘরকে বদলে দিতে পারে। আছে বাতাসি পর্দা, যা দিয়ে বাইরের পোকামাকড় বা বৃষ্টির ছাঁট বা ঝোড়ো হাওয়া রুখে দেওয়া যায়–জানলা বা দরজায় কপাটের দরকার হয় না। বাতাসি পর্দাকে অস্বচ্ছ করে দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। জানলা-দরজার প্যানেলে সরু সরু ছিদ্র দিয়ে প্রবল বায়ুর প্রবাহই হচ্ছে বাতাসি পর্দা।