সেটেলমেন্ট অফিসের লোকদের কিছু উপরি আয় থাকে। সে তেমন কিছু নয়। সুধন্যরও ছিল। এ-বাড়ির গাঁথুনিতে সবই গাঁথা হয়ে গেছে। হাতে তেমন কিছু নেই।
ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে ডিবেটার যাওয়ার কথা নয়। তবু তিনি শেফালির ব্যাগটা পেরেক থেকে নামিয়ে আনলেন। কিন্তু খুলতে পারছিলেন না। এ সময়টায় শেফালি তার কোন বান্ধবীর বাড়িতে পড়া বুঝতে যায়। পার্ট টু পরীক্ষা দিচ্ছে এবার। ধারেকাছে কেউ নেই। ব্যাগটার মুখ এমন হাঁসকল দিয়ে লাগানো যে নানা রকম টিপ আর চাপ দিয়েও অনেকক্ষণ খুলতে পারলেন না।
তারপর হড়াক করে টান দিতেই সহজে খুলে গেল। ভিতরে বেশি কিছু নেই। কয়েকটা খুচরো পয়সা, লিপস্টিক আর খুদে গোল আয়না, কলেজের মাইনের রসিদ বই, পেন, ভুরু আঁকার পেনসিল, একজোড়া গগলস। ডিবেটা নেই। কলেজের মাইনের রসিদ-বইটার ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা চিঠি বেরিয়ে আছে।
আজকাল সময় কাটে না। তাই চিঠিটা দেখে খুশি হলেন সুধন্য। মেয়ে চিঠিপত্র পাচ্ছে তাহলে! দেখতে ভালো নয় মেয়েটা, চিঠি পাওয়াটা সুলক্ষণ। ছেলেটা যদি জাতের হয় তো বরং উৎসাহই দেবেন!
চিঠিটা খুলে চশমা এঁটে দেখে একটু হতাশ হলেন। প্রেমপত্র নয়। আবার নয়ও বলা যায় না। অমল নামে একটা ছেলের চিঠি। সে পলাশি ছেড়ে কলকাতায় চলে গেছে। সেখান থেকে পলাশির জন্য মন-কেমন-করা চিঠিতে নানা জনের খবর জানতে চেয়েছে। কেষ্টনগর কলেজে একসঙ্গে পড়ত বোধ হয় একসময়ে। চিঠির শেষে ‘ভালোবাসা’র বদলে ‘প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়েছে। নীরস চিঠি। বানান ভুলও অনেক চোখে পড়ে। বাঙাল ছেলে বোধহয়। বাড়ি বানান ‘বারি’ লিখেছে।
যথাস্থানে চিঠিটা রেখে দিলেন। ডিবেটা পাওয়া গেল না। কোথায় যে নিজেই রাখলেন, বা হেমন্তবালা ফেলে দিলেন—তা বোঝা যাচ্ছে না। আবার নতুন ডিবে আর নস্যি কিনতে বাজার পর্যন্ত ধাওয়া করা বড় ঝামেলার ব্যাপার।
পলাশিতে বাড়ি করাটাই কি ভুল হয়েছিল? এ অঞ্চলটা আসল পলাশি নয়, এর নাম মীরবাজার, আসল পলাশি অনেকটা দূর, সেখানে চিনিকল হয়েছে, আশেপাশে আখের চাষ হয়। সিরাজদ্দৌল্লার যুদ্ধক্ষেত্র এখন মাঠ জঙ্গল পড়ে আছে। সে আমবাগানও নেই। তবু পলাশি নামটা বড় বেশি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। কিন্তু স্টেশনের কাছে এই মীরবাজারও সেই আদ্যিকালে পড়ে আছে। কলকাতা চার ঘণ্টার পথ লালগোলা প্যাসেঞ্জারে। কেষ্টনগর না গেলে ভালো জিনিস পাওয়া মুশকিল। কলেজও কেষ্টনগরে। সেখানেই চাকরি করতেন সুধন্য। ত্রিশ টাকায় ঘর ভাড়া করে থাকতেন। তারপর বন্ধু সুধীর বাঁড়ুজ্যের পাল্লায় পড়ে মীরবাজারে বাড়ির জন্য জমি কিনলেন। কোনও মানে হয় না। কতগুলো টাকা বাড়িটায় আটকে রইল। কেউ-কেউ পরামর্শ দিয়েছিল আরও ক’খানা ঘর তুলে ভাড়া দিতে। সেটা করেননি ভালোই করেছেন। কারণ ভাড়া নেওয়ার লোক জুটত না। মীরবাজারে কে আর থাকতে আসবে? তাই ভাবেন বাড়িটা করাই ভুল হয়েছিল। ত্রিশ টাকা করে বছরে তিনশো ষাট টাকা টেনে গেলেও হাতের পাত্রে কিছু থাকত, শেফালির বিয়েটা দিতে পারতেন; বঁচিরও একটা গতি হত।
বুঁচি কোথায় খেলতে গিয়েছিল। সারাদিনই পাড়া বেড়ায়, ঘেমো শরীর নিয়ে হাঁসফাঁস করতে-করতে দৌড়ে ঘরে এল। বিছানার তোশক থেকে একটা ন্যাকড়ার পুতুল বের করে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, হেমন্তবালা তক্কে ছিলেন, উঠে এসে ডাকলেন বুঁচি?
বুঁচি দৌড়।
হেমন্তবালার হাতে একটা বেলনা। সেইটে বাগিয়ে নিয়ে তিনিও দৌড়ে বেরোলেন।
–বুঁচি-ই!
সুধন্যর সময় কাটে না।
তিনিও দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। খুবই চমৎকার দৌড় হচ্ছে। বুঁচি হরিণের মতো দৌড়োয় বটে, কিন্তু হেমন্তবালাও যে এ-বয়সে এত জোর ছুটতে পারেন তা সুধন্যর জানা ছিল না।
সামনের একটু মাঠ মতো, তারপর রাস্তা। বুঁচি রাস্তায় উঠে গিয়েও রেহাই পায়নি। হেমন্তবালা শাড়ি সামলে চমৎকার দ্রুতবেগে ঝুঁচির চার হাতের মধ্যে চলে গেছেন।
বুঁচি একবার পিছু ফিরে চেয়ে এত অবাক যে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল আর কি? একেবারে এক চুলের জন্য বেঁচে গেল। ‘উ মা গো!’ বলে আবার উধ্বশ্বাসে বুঁচি দৌড়ে নাগালের বাইরে চলে গেল।
হেমন্তবালা কদমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছেন।
কষ্ট হয় সুধন্যর।
হেমন্তবালা করুণ সুরে চেঁচিয়ে বললেন, বুঁচি!
বুঁচি দূরে দাঁড়িয়ে হিহি করে হাসে।
হেমন্তবালা প্রায় কান্নার মতো স্বরে বলেন, বঁচি রে, তোর ধর্ম কি এই বলে? অ্যাঁ? তোর ধর্ম তোকে এই বলে?
কী করুণ আবেদন! শুনে সুধন্যরও মায়া হয়।
কিন্তু হেমন্তবালার গলার স্বর হঠাৎ বদলে গেল। হাতের বেলনাটা তুলে পুলিশের মতো আস্ফালন করে চিৎকারে পাড়া মাত করে কর্কশ স্বরে বলতে থাকেন, আসিস আজকে। ভাতের পাতে ছাই বেড়ে দেব। খাবি না বুঁচি, অ্যাঁ? খেতে আসবি না? তখন দেখিস।
এই বলে হেমন্তবালা ফিরে আসছিলেন।
এ সময়টায় মুখোমুখি হওয়া ভালো নয়। অভিজ্ঞতাবলে সুধন্য জানেন, মেয়েদের ওপর রাগ করলে হেমন্তবালা আবার সুধন্যর ওপরেও অকারণে চটে যান।
সুধন্য ঘরের পিছনদিকে গা ঢাকা দিয়ে রইলেন একটু।
হেমন্তবালা যখন উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছেন, তখনই সুধন্য দেখলেন চোর একটা বেড়াল দুটো খয়রা মাছ মুখে নিয়ে জবা গাছটার তলায় গিয়ে বসল। সুধন্য বড় ব্যথিত হলেন। সপ্তাহে তিনদিন মাছ হয়। একপো খয়রা মাছ কিনতে আজ তাঁকে দুটো টাকা নগদ দিতে হয়েছে। তার দুটো ওই গেল বেড়ালের পেটে।