সুধন্যও তেমন সাহস পাচ্ছেন না বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করতে। যৌবনকালটা এই নস্যি নিয়ে বড় অশান্তি গেছে।
ফুলশয্যার রাতে বউয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের প্রাক্কালে সুধন্য এক টিপ প্রচণ্ড নস্যি নিয়ে স্নায়ু ঠিক রাখার চেষ্টা করেছিলেন। নতুন বউ হেমন্তবালা প্রথম কাছে এসে খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি নস্যি নাও?
লজ্জিত সুধন্য বললেন, নিই মাঝে-মাঝে।
—এ মা গো। ননাংরা জিনিস। সিগারেট খেতে পারো না?
সুধন্য নিভে গিয়েছিলেন। নতুন বউ নস্যি ঘেন্না পায়, কিন্তু তিনি করেন কী! ইস্কুলের নীচু ক্লাস থেকে নেশা ছাড়ানোও যায় না।
তবুনতুন বউয়ের ঘেন্না দেখে বিয়ের পর-পর নস্যি ছেড়ে সিগারেট ধরেন। কিন্তু তাতে চোখে জল আসে, গলা খুসখুস করে। নেশা আসে না। উপরন্তু নস্যির অভাবে সারাদিন নাকে জল আসে, হাঁচি আসে, মাথাটা ঘোলাটে লাগে। এক টিপ নস্যির জন্য প্রাণ আনচান করে।
হেমন্তবালা বলতেন, নস্যি নেওয়া পুরুষ বড় বিশ্রী।
সুধন্যর বিশ্রী হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তবু পুরুষকার দিয়ে নস্যির ওপর জয়ী হওয়া যায়নি। তাঁর অবস্থা দেখে অবশেষে তাঁর মা তাঁকে ডেকে বলেন, বাবা, নস্যি না নিলে তুই কি বাঁচবি? সারাদিন তোর মুখচোখ কেমনধারা জলেডোবা মানুষের মতো দেখায় যে! নতুন বউ রাগ করে তো করুক, মেয়েরা বড় ট্যাটন হয়। ওসব মন বুঝে অত চলতে নেই। পেয়ে বসবে। তুই পুরুষ, পুরুষের মতো হ। নস্যি ধর আবার, নইলে শরীর পাত হয়ে যাবে। নেশা কি সহজে ছাড়া যায়?
মায়ের আদেশে সুধন্য আবার নস্যি ধরেন। নস্যি ধরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন বটে, কিন্তু হেমন্তবালা এক সপ্তাহ কথা বললেন না। তারপর যখন বললেন সেই কথাও আগ্নেয়গিরির মুখ। থেকে বেরিয়ে আসা লাভা ছাড়া কিছু নয়। তবু সুধন্য যেমন নস্যি ছাড়তে পারলেন না, তেমনি হেমন্তবালাও স্বামীকে ছাড়তে পারলেন না। তবে নস্যি তাদের বিবাহিত জীবনের একটা স্থায়ী অশান্তির কারণ হয়ে রইল। পরে হেমন্তবালা সুধন্যর নস্যির ন্যাকড়াও কেচে দিয়েছেন, তবু এই বুড়ো বয়সেও সুধন্যকে নস্যির জন্য কথা শুনতে হয়। রাগ হলে হেমন্তবালা এখনও সুধন্যর নস্যির কৌটো বাইরে ছুড়ে ফেলে দেন। কতবার নতুন ডিবে কিনতে হয়েছে।
আজ সকালেও নস্যি নিয়েছেন বেশ কয়েকবার। আজকাল কিছু বেশি নেন। সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসর পেয়েছেন, হাতে কাজ নেই, ফালতু দিন, ফালতু সব সময়। এত ছুটি কাটাবেন কী করে তাই ভাবতে-ভাবতে টিপের-পর-টিপ নস্যি নিয়ে নেন। হিতাকাঙ্ক্ষীরা বলে—কপালে নস্যি জমে নাকি মানুষ মরে যায়!
সুধন্য ভাবেন—তা হবে। সিগারেট, তামাকপাতায় ক্যানসার হয়। মদে লিভার সিরোসিস হয়। আফিং খেলেও কিছু-না-কিছু হয়। নেশা করলে ওসব তো আছেই।
নস্যির কৌটোটা খুঁজে না পেয়ে খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল। বিছানার তোশক উলটে দেখলেন, খাটের তলা খুঁজলেন, তাকটাকগুলো সবই খুঁজলেন। কোথাও নেই। একটা জীবন ধরে নিজের একটু বাড়ি করতে পেরেছেন তিনি। মফসসল শহর বলে জমির দাম বেশি লাগেনি, চুন-সুরকির গাঁথুনি দেওয়ার খরচ কমই হয়েছে। দু-খানা মাত্র ঘর মাঝখানে একটু উঠোন, ওধারে রান্না আর স্নান ইত্যাদির ঘর। কিছুই না। তবু খুব কষ্ট গেছে এটুকু করতেই। দেওয়াল ওঠে তো ছাদ হয় না, ছাদ হল তো পলেস্তারা বাকি থাকল, সেটা করলেন তো বারান্দা সিমেন্ট করা বাকি থাকল। সে একটা লড়াই গেছে। লড়াই যখন শেষ হয়েছে তখন বয়সও শেষ। বাড়ি ভোগ করার বাকি আর অল্প দিনই। তবু একটু তৃপ্তি, শেষ তো হল। সারা জীবনে নিজের বাড়ি’ বলে বলার মতো কিছু
তো হল।
অন্যমনস্কভাবে ডিবেটা খুঁজতে-খুঁজতে বাইরের দিককার ঘরটায় এলেন। জোড়া বিছানায় বুঁচি আর তার দিদি শেফালি শোয়। দুটোই মেয়ে সুধন্যর। বেশি বয়সে বেশ পরপর দুটো মেয়ে হল। বিয়ে দেওয়ার সময় পাওয়া যাবে কি? বড় মেয়ে শেফালির বিশ বছর বয়স চলছে, বঁচির মোটে বারো। শেফালির জন্য তোড়জোড় করতে হয়। হাত খালি বলে তেমন উৎসাহ পান না। মেয়ে তেমন সুন্দর নয়, যদিও খুবই আদরের।
এ-ঘরটায় পড়ার টেবিল রয়েছে কেরোসিন কাঠের। সস্তা আলনা, বইয়ের র্যাক। এসো-জন বোসো-জনের জন্য কয়েকখানা টিনের চেয়ার। তাতে শেফালি আর হেমন্তবালার নিজেদের হাতে কাজ করা সব ঢাকনা। দেওয়ালে রবি ঠাকুর আর বালগোপালের ছবি। পড়ার টেবিলের ওপর একটা সস্তা ট্রানজিস্টার রেডিও, নেভানো হারিকেন, ছড়ানো বইপত্র। সবই হাতড়ে দেখেছেন সুধন্য, তবু আর-একবার দেখলেন। হারিকেনের তলায় নস্যির ডিবে থাকার কথা নয়। তবু সন্দেহ থাকে কেন ভেবে সুধন্য হারিকেনের তলাও দেখলেন।
নাকটা সুড়সুড় করছে, জল আসছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি কালের নেশা। নস্যি না হলে পাগল-পাগল লাগে।
দেওয়ালের পেরেকে একটা লাল ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলছে। শেফালির। আজকাল গরিবের মেয়েদেরও এসব থাকে—ভ্যানিটি ব্যাগ, লিপস্টিক, ঘড়ি। তাঁর মেয়েরও আছে। একটা জীবন। ধরে ল্যান্ড সেটেলমেন্ট অফিসের কেরানি ছিলেন, বুড়ো বয়সে রিটায়ারমেন্টের আগে কিছুদিনের জন্য বড়বাবু হয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরই পুরোনো অফিসের বড়বাবু হওয়ায় পুরোনো সহকর্মীরা তেমন মানসৎমান করত না, মানতও না খুব একটা। তবু বড়বাবু হয়েছিলেন। কিন্তু গা থেকে গরিব-গরিব গন্ধটা আর গেল না। নস্যির গুঁড়োর মতো লেগে রইল গায়ে। কিন্তু মেয়ে বউকে কষ্ট দেননি তেমন। যথাসাধ্য অভাব মিটিয়ে গেছেন। যতদিন মা বেঁচেছিলেন ততদিন মাকেও সুখেই রেখেছেন। ধকল যা কিছু নিজের ওপর দিয়ে গেছে।