সুতরাং মণিকা বুঝতে পারে, এতকাল ছোট সুখ, ছোট দুঃখের সঙ্গেই ছিল তার ভাব ভালোবাসা। এখন হঠাৎ সদর দুয়ার গেছে যে খুলে, অচেনা, বিশাল পুরুষের মতো এক বড় দুঃখ এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। লুবিয়ার মতো, মণিকার ছোট মাথা তা বইতে পারে না। এ যে আকাশ পর্যন্ত ব্যাপ্ত, এ যেন সমুদ্রের মতো সীমাহীন, এ দুঃখ দাবি করে সর্বস্ব। সমগ্র ভুবন কেড়ে নেয়।
দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে এসেছে টুকুন। ভাত খেয়ে আলাদা বিছানায় ঘুমুচ্ছে। বড় ঘাম হয় ছেলেটার। একটা মাত্র পাতলা জামা গায়ে, তবু জলধারায় ভেসে যাচ্ছে গলা বুক। কপালে মুক্তবিন্দু, মণিকা নীচু হয়ে টুকুনের মুখ দেখে। সবাই বলে ওর শরীরের গঠন আর চোখ দুখানা সঞ্জয়ের মতো। নিবিড় পিপাসায় দেখে মুখখানি, মণিকা ফিসফিস করে ডাকে।
–টুকুন।
টুকুন উত্তর দেয় না।
—ওঠ টুকুন।
টুকুন উত্তর দেয় না।
–ওরে টুকুন বেলা গেল। ওঠ।
টুকুনের উত্তর নেই। নিঃসাড়ে ঘুমোয় সে। নিশ্চিন্তে।
টুকুন ওঠ রে, আয় দুজনে মিলে একটু কাঁদি। ডাক্তার বাসুর চেম্বারে ফোন করল মণিকা, পোস্ট অফিসে গিয়ে।
—ডক্টর বাসুর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
–উনি দিল্লিতে আছেন।
–কবে ফিরবেন?
–কনফারেন্সে গেছেন। কাল কি পরশু ফেরার কথা।
—আমার যে ভীষণ দরকার।
–কী দরকার বলুন। দয়া করে বলবেন, ডাক্তারবাবু কীসের স্পেশালিস্ট।
ও-পাশে লোকটা বোধহয় একটু হাসল, বলল : ক্যান্সার।
—আমি কাল আবার ফোন করব। কোন সময়ে আসার কথা?
–সকালের ফ্লাইটে। তবে কিছু বলা যায় না, হয়তো আটকেও যেতে পারেন।
মণিকা সন্তর্পণে ফোনটি রেখে দেয়। বাসায় ফিয়ে দেখে সঞ্জয় শুয়ে আছে। উত্তর শিয়রে মাথা, পায়ের কাছে দক্ষিণের জানালা। শেষবেলার একটু রাঙা আলো এসে পড়ে আছে পাশে। সঞ্জয় চেয়ে আছে দক্ষিণের জানালা দিয়ে। অবিরল চেয়ে থাকে আজকাল। কথা বড় একটা বলে na। টুকুনকে আদর করে না, মণিকাকেও না।
শেষ চান্স-এ হলুদ বেলুনটা না ফাটলে কোথায় থাকত মণিকা আর কোথায়ই বা সঞ্জয়। মণিকা সঞ্জয়ের দিকে চেয়ে থাকে। পিপাসায় তারা ঠোঁট নড়ে, তার দু-চোখ জলে ভেসে যায়। অচেনা পুরুষের মতো বড় দুঃখ এসে দাঁড়িয়েছে দুয়ার খুলে। হাতে তার হাওয়া বন্দুক, হলুদ বেলুনের মতো ঝুলে আছে। মণিকার হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ হবে, ভেঙে যাবে বুক।
মণিকা শব্দ করে কেঁদে উঠে। অবাক হয়ে সঞ্জয় চোখ ঘোরায়।
–কী হয়েছে?
—পাষাণ, তুমি পাষাণ। সঞ্জয় বুঝতে পেরে মাথা নাড়ে, শ্বাস ফেলে বলে কেঁদো না, আমাকে বরং এখন থেকে একটা করে সিগারেট দিও রোজ।
মণিকা হঠাৎ মুখ তুলে বলে—সিগারেট আর সিগারেট! সংসারে সিগারেট ছাড়া তোমার আর কিছু চাওয়ার নেই?
না—মাথা নাড়ল সঞ্জয়।
—পাষাণ, তুমি পাষাণ। মণিকা কাঁদে, সঞ্জয় চুপ করে দক্ষিণের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখে, টুকুন পাশের ঘরে ঘুমোয়।
অনেক কষ্টে ডাক্তার বাসুর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারে মণিকা। সঞ্জয়কে নিয়ে একদিন হাজির হয় ছায়াচ্ছন্ন চেম্বারটায়। বাসু প্রবীণ ডাক্তার, বিচক্ষণ অভিজ্ঞ দুটি চোখ তুলে বললেন—কী হয়েছে? দেখি! বলে সঞ্জয়কে চেয়ারে বসালেন। আলো জ্বালালেন কয়েকটা, ঝুঁকে ওর মুখ দেখতে লাগলেন, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে মণিকা, হাওয়া-বন্দুক তুলেছে এক পাষাণ, দেওয়াল ঘড়ি পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে, বুকের ভিতরটা এক হলুদ বেলুন দাঁতে চিবিয়ে আজও রুমাল ছিড়ল মণিকা।
ডাক্তার বাসু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন—কিছু হয়নি।
–মানে? সঞ্জয় প্রশ্ন করে।
–যা সন্দেহ করে এসেছেন আমার কাছে, তা নয়। আজকাল সকলেরই এক ক্যান্সারের বাতিক, স্মোক করেন?
–করতাম।
–টনসিলটা পাকা। ফ্যারিঞ্জাইটিস আছে, সব মিলিয়ে একটা আলসার তৈরি হয়েছে, ওষুধ লিখে দিচ্ছি। সেরে যাবে।
ডাক্তারবাবু ওষুধ লিখে দিলেন।
সেরেও গেল সঞ্জয়।
একদিন বলল, শোনো মণিকা।
–কী?
মনে আছে একবার মেলায় তোমাকে বাজি রেখে হাওয়া-বন্দুকের খেলা খেলেছিলাম?
–মনে আছে।
—সেজন্যে আমাকে ক্ষমা করো।
মণিকা হাসে—তুমি কী ভাবো, শেষ চান্সে বেলুনটা না ফাটালে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম?
—যেতে না?
—পাগল।
—কী করতে?
—আমি বন্দুকটা নিয়ে বেলুনটা ফাটাতাম। না পারলে সেফটিপিন ফুটিয়ে আসতাম বেলুনটায়!
—তুমি ডাকাত, বলে সঞ্জয় হাসে।
অলক্ষ্যে হাওয়া-বন্দুক নামিয়ে পরাজিত এক অচেনা পুরুষ ফিরে যায়। তার লক্ষ্যভেদ হল। বিদীর্ণ হয়নি মণিকার হৃদয়। সব ঠিক আছে। কোনওদিন আবার সেই বন্দুকবাজ ফিরে আসবে। লক্ষ্যভেদ করার চেষ্টা করবে বারবার, একদিন লক্ষ্যভেদ করবেও সে। ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীর এই রঙিন মেলায় আনন্দিত বাতাস বহে যাক এই কথা বলে—ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।
হারানো জিনিস
নস্যির কৌটোটা কোথায় যে রাখলেন সুধন্য, কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না। নাক দিয়ে জল আসছে, সুড়সুড় করছে, ভারী অস্বস্তি। সম্ভব অসম্ভব সব জায়গাতেই খুঁজেছেন। দু-একবার মিনমিন করে বউ হেমন্তবালাকেও জিগ্যেস করেছেন, জবাব পাওয়া যায়নি। হেমন্তবালা রেগে আছেন, ছোট মেয়ে কুঁচি পুরোনো তেঁতুলের শেষ একটা ডেলাও চুরি করে নিয়ে গেছে। পুরোনো। তেঁতুলের একটা মাখা করতে গিয়ে হেমন্তবালা ডেলাটুকু বের করে ধনেপাতা, গুড়, লংকা সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। পুরোনো তেঁতুলের এই মাখাটা তাঁর বড় প্রিয়। সবই পড়ে আছে। ধনেপাতা, লংকা, গুড়, কেবল তেঁতুলটুকুই নেই। একটু আগে ফ্রকের কোঁচড় ভরে মুড়ি নিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে ওই হতচ্ছাড়া মেয়েটা। ওরই কাজ। সেই থেকে হেমন্তবালা কারও কথার উত্তর দিচ্ছেন না।