মণিকা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে তার মানুষটাকে। কী মস্ত শরীর, মাত্র বত্রিশ বৎসর বয়সের যুবক স্বামীটি তার কী হল, কী হতে পারে মানুষটার?
–কী হয়েছে তোমার ওগো?
–কী জানি, কাশি এল খুব, কাশতে-কাশতে বমি হয়ে গেল। আমাকে একটু শুইয়ে দাও।
…বাইরে বাসের হর্ন বাজে। টুকুন দৌড়ে আসে। মা, বাস এসে গেছে। টিফিন বাক্স আর জলের বোতল দাও।
—দিচ্ছি, দিচ্ছি বাবা।
টুকুন বাবাকে জিগ্যেস করে–কী হয়েছে বাবা?
—কিছু না।
—শুয়ে আছ কেন? আজ তোমার ছুটি?
সঞ্জয় শ্বাস ফেলে বলে—ছুটি! না ছুটি নয়। তবে বোধহয় এবার ছুটি হয়ে যাবে।
—কেন বাবা?
—মাঝে-মাঝে মানুষের ছুটি হয়ে যায় বিনা কারণে। বলে সঞ্জয় হাসে। বলে, তোমাকে খ্যাপালাম। কিছু হয়নি। তুমি ইস্কুলে যাও।
–যাই বাবা, টাটা।
টাটা! বাইরে বাসের শব্দ হয়।
মণিকা গম্ভীরস্বরে ঘরে আসে। হাতে দুধের কাপ। চামচে দিয়ে ভাসন্ত পিঁপড়ে তুলছে। কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে—দুধটা খেয়ে নাও।
—খেতে ইচ্ছে করছে না। এখনও বমির ভাবটা আছে। খেলে বমি হয়ে যাবে।
—আমি ডাক্তারকে খবর দিয়েছি।
সঞ্জয় একটা শ্বাস ফেলে বলে, সিগারেটের প্যাকেটটা দাও।
–না, আর সিগারেট নয়।
—দাও না, মুখটা টক-টক লাগছে। সিগারেট খেলে বমির ভাবটা কমবে।
মণিকা বলল, না, এত বাড়াবাড়ি আমি করতে দেব না।
ওঃ, বলে সঞ্জয় হতাশভাবে চেয়ে থাকে।
—শোনো, তুমি টুকুনকে কী বলছিলে?
—কী বলব?
—কিছু বলনি? আমি পাশের ঘর থেকে সব শুনেছি।
সঞ্জয় একটু হাসে—কী শুনেছ?
—ওইটুকু ছেলেকে ওইসব কথা বলতে তোমার মায়া হল না?
—ওকি বুঝেছে নাকি?
—না-ই বা বুঝল? তুমি বললে কেন? ছুটি মানে কী তা কি আমি বুঝি না?
—কি মানে বলো তো?
–বলব না। তুমিও জানো, আমিও জানি।
—মণিকা সিগারেট দাও।
–না।
—তাহলে আবার কাশি শুরু হবে।
—হোক, সিগারেট কিছুতেই দেব না। আগে বলো কেন বলেছিলে ওই কথা।
—এমনিই।
মণিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া একটা দৃশ্য মনে পড়ে। মেলার দোকানে মণিকাকে বাজি রেখে হাওয়া-বন্দুক লক্ষ্যভেদের খেলা খেলছে সঞ্জয়। জীবনে মণিকা কোনওদিনই ঘটনাটা ভুলতে পারবে কি? পারবে না। মনে কেবলই সংশয় খোঁচা দেয়। যাকে ভালোবাসে মানুষ তাকে কী করে এক মুহূর্তের খেয়াল-খুশিতে হারজিতের খেলায় নামিয়ে আনতে পারে? তবে কি সঞ্জয় কোনওদিনই তেমন করে ভালোবাসেনি তাকে? সেই জন্যই কি এই সাজানো সুন্দর সুখের সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার বড় সাধ হয়েছে তার? ও টুকুনকে কেন বলল মাঝে-মাঝে মানুষের ছুটি হয় বিনা কারণে। ওই ছুটির জন্য বড় সাধ সঞ্জয়ের?
মণিকা বিছানার একধারে বসল। স্বামীর মাথাটা টেনে নিল বুকের ধার ঘেঁষে। চুল এলোমেলো করে দিতে-দিতে বলল, অমন কথা বলতে নেই, কখন স্বস্তির মুখে কথা পড়ে যায়। আর কখনও বোলো না।
—আচ্ছা।
—আমাকে ছুঁয়ে বলল, বলবে না।
সঞ্জয় হাসল, বলল, সিগারেট দাও না মণিকা।
–না।
বাইরে বাড়িওয়ালার ছেলের ডাক শোনা যায়—বউদি।
মণিকা বলে—বোধহয় পন্টু ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এল।
মণিকা বলল—আসছি পন্টু। মণিকা গিয়ে দরজা খোলে। ডাক্তারবাবু ঘরে আসেন।
–কী হয়েছে? ডাক্তারবাবু জিগ্যেস করেন।
সঞ্জয়ের কাশির দমকাটা আবার আসে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে—কিছুনা। স্মোকারস কাফ।
—দেখি, আপনি ভালো করে শুন তো।
ডাক্তার সঞ্জয়কে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন। মণিকাকে একটা টর্চ আনতে বলেন, টর্চ দিয়ে গলাটা দেখেন ভালো করে। গলার বাইরের দিকে কয়েকটা জায়গা একটু ফুলে আছে। সেগুলো হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখে জিগ্যেস করেন—এগুলো কতদিন হল হয়েছে?
—কি জানি! সঞ্জয় উত্তর দেয়।
ডাক্তারবাবুর মুখটা ক্ৰমে গম্ভীর হয়ে আসে। একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে ওঠেন। মণিকা তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের ঘরে আসে।
—ডাক্তারবাবু।
–বলুন।
–কীরকম দেখলেন?
—তেমন কিছু বুঝতে পারছি না। ওষুধগুলো দিন। দেখা যাক।
হঠাৎ এক অনিশ্চয়তা, এক ভয় চেপে ধরে মণিকার বুক। ভগবান, ডাক্তার কেন বুঝতে পারছে না?
কয়েকদিন কেটে যায়। ওষুধে তেমন কোনও কাজ হয় না। কাশিটা যেমনকে তেমন থেকে যায় সঞ্জয়ের। কিছু খেতে পারে না, ওয়াক তুলে বমি করে ফেলে। শরীরটা জীর্ণ দেখায়। মস্ত চুল ভরতি মাথাটা বালিশে ফেলে রেখে পায়ের দিকের জানালাটা দিয়ে উদাসভাবে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। কেবল চেয়ে থাকে।
মণিকা ডাকে—শুনছ?
–উঁ।
—একটু হাঁটাচলা করো। শুয়ে থাকো বলেই তোমার খিদে পায় না।
—একটা সিগারেট দেবে মণিকা?
–না।
—পাষাণ, তুমি পাষাণ!
মণিকার চোখে জল আসে, বলে—কোনওদিন তো বারণ করিনি জোর করে। অসুখ হল কেন বলো। ভালো হও তারপর খেও।
—যদি ভালো না হই?
—ফের ওই কথা? তুমি বলেছিলে না যে আর বলবে না।
সঞ্জয় শ্বাস ফেলে, চুপ করে থাকে। ডাক্তার মাঝে-মাঝে এসে তাকে দেখে যায়। একদিন চিন্তিতমুখে ডাক্তার মণিকাকে আড়ালে ডেকে বলে—গলার ঘাটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। বরং ডাক্তার বসুকে একবার দেখান।
—আপনার কী মনে হয়।
—কিছু বলা মুশকিল। দীর্ঘস্থায়ী কোনও ঘা দেখলে অন্যরকম একটা সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হয়তো তেমন কিছুই নয়। তবু দেখালে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ডাক্তারবাবু চলে গেলে মণিকা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তারের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে তার দেরি হয় না। ডাক্তাররা সহজে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে না, সুতরাং–