রাতে আজকাল সঞ্জয় বড় বেশি কাশে। কাশতে কাশতে দম আটকে আসে তার। মণিকা ওঠে জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে—জল খাও তো!
–দাও।
–কাল তুমি ডাক্তারের কাছে যেও।
—দূর-দূর! ডাক্তাররা একটা-না-একটা রোগ বের করেই, রোগ না থাকলেও। এ-কাশি কিছু না। সিগারেটের প্যাকেটটা দাও তো টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে।
—খেও না, পায়ে পড়ি।
—আঃ, দাও না। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া কমবে না।
–রোজ তোমার এক কথা। তুমি আগে ডাক্তার দেখাও তো!
—ডাক্তাররা কিছু জানে না।
—তুমি খুব জানো।
—আমি ঠিক জানি। বরং একটা ওষুধ কিনে আনব।
মণিকা বিছানায় বসে সঞ্জয়ের চওড়া রোমশ বুকের ওপর হাত রাখে স্নেহে, এই পুরুষটিকে সে খুব চিনে গেছে। ভারী একগুঁয়ে, জেদি। তবু ভেতরে-ভেতরে মেয়েদের মতোই নরম।
বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মণিকা বলে–নিজের ওপর তোমার একটুও নজর নেই। সারাদিন চা আর সিগারেটের ওপরে আছ। এ তো ভালো নয়, বুঝলে? কাল থেকে সকালে আর দু-কাপ চা দেব না, দ্বিতীয় বারে, চায়ের বদলে দুধ দেব।
—ধুস।
ওসব বললে চলবে না। খেতে হবে, আর অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে। সারাটা দিন তো বাসাতেই থাকো না। ঠিক যেন পেয়িং গেস্ট।
–সারাক্ষণ ঘরে থাকা যায়?
—তাহলে আমি কী করে থাকি?
—মেয়েরা পারে, সংসারে তাদের জান পোঁতা হয়ে থাকে।
-তাই নাকি! আর, তোমার জান কোথায় পোঁতা আছে শুনি। নতুন করে কারও প্রেমে পড়োনি তো?
সঞ্জয় হাসে, ইচ্ছে তো করে একটা হারেম বানিয়ে ফেলি কিন্তু এ-বয়সে কে আর ফিরে তাকাবে বলো।
ফিরে তাকাবার লোকের অভাব নেই। সেদিন মনুর বিয়েতে ওর যে একদল কলেজের বন্ধু এসেছিল তাদের মধ্যে একজন শ্যামলা মতো মেয়ে হাঁ করে তোমাকে খুব দেখছিল।
–যাঃ! তোমার যত বানানো কথা।
–সত্যি বলছি, মাইরি।
—আমার গা ছুঁয়ে বলছ তো।
—ও বাবা! বলে মণিকা হাত টেনে নেয়।
–কী হল! হাতটা সরিয়ে নিলে কেন?
—তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম যে।
সঞ্জয় হাসে, গা ছুঁয়ে বলতে সাহস হচ্ছেনা, তার মানে মিথ্যে কথা বলছ।
—না গো, সত্যিই মেয়েটা দেখছিল।
—তবে গা ছুঁয়ে বলল।
—না-না। তোমাকে ছুঁয়ে আমি কখনও দিব্যি গালি না।
সঞ্জয় বলল—তাহলে বলি, তুমি যে বড় দর্জির দোকানে ব্লাউজ বানাতে দাও, সেখানকার সুন্দর মতো সেলসম্যানটি তোমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকে—
–যাঃ, বলবে না, নোংরা কথা। বলে মণিকা।
আর সেদিন পাড়ার ছেলেরা যে চাঁদা চাইতে এসেছিল তাদের মধ্যে একজন কেন তোমার কাছে জল খেয়ে গেল জানো?
—এই, এই, এমন মারব না; কেবল বানাচ্ছে, চুপ করো। ওসব শুনলেও পাপ।
তারা দুজনেই খুব হাসতে থাকে। কারণ তারা জানে ওসব কথা সত্যি নয়, কিংবা হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের ভালোবাসা গভীর, গভীর।
সকালে টুকুন দুলে-দুলে পড়ছে ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ, হ্যাভ ইউ এনি উল? ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার, থ্রি ব্যাগস ফুল।
মণিকা রান্নাঘরে ঝিকে বকছে—রোজ তোমার আসতে বেলা হয়ে যায়। এঁটো বাসনপত্র পড়ে আছে, ঝাঁটপাট হয়নি, সাতটা বেজে গেল, টুকুনের স্কুলের বাস আসবে এক্ষুনি, কখন কী হবে বলো তো?
ঝি উত্তর দেয়, কী করব বউদি, বড় বাড়িতে বেশি মাইনে দেয়, তারা সহজে ছাড়তে চায় না। কেবল এটা করে যাও, ওটা করে যাও। তোমার বাড়ি সেরে আবার এক্ষুনি ও-বাড়ি দৌড়তে হবে।
—বেশি মাইনে যখন, তখন ও-বাড়ির কাজই ধরে রাখো, আমারটা ছেড়ে দাও। আমি অন্য লোক দেখে নিই, পইপই করে বলি আমার ছেলের সকালে ইস্কুল, কর্তারও অফিস ন’টায় একটু তাড়াতাড়ি এসো। তুমি কেবল বড়লোকের বাড়ির বেশি মাইনের কাজ দেখাও।
[ বাথরুম থেকে ক্রমান্বয়ে কাশির শব্দ আসে ]
টুকুন এক নাগাড়ে ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ পড়ে যাচ্ছে। মণিকা ডাক দিয়ে বলে, টুকুন কেবল ওই কবিতাটা পড়লেই হবে। একটু অঙ্ক বইটা দেখে নাও। কাল অঙ্কে ব্যাড পেয়েছ।
মণিকা–বাথরুম থেকে ক্ষীণ গলায় সঞ্জয় ডাকে।
মণিকা উত্তর দেয়, কী বলছ?
—একটু শুনে যাও।
—দাঁড়াও, আমার হাত জোড়া, ডালে সম্বর দিচ্ছি।
—এসো না।
–উঃ, আমি যেতে পারব না। টুকুনের টিফিন বাক্স গোছানো হয়নি, জলের বোতলে জল ভরা হয়নি। এক্ষুনি বাস এসে পড়বে।
সঞ্জয় চুপ করে থাকে, তারপর আবার শোনা যায়, তার কাশির শব্দ। দম বন্ধকরা সেই কাশি; তার পরই ওয়াক তুলে বমি করার শব্দ হয়।
—ওমা! কী হল! বলে মণিকা উঠে বাথরুমের বন্ধ দরজায় এসে ধাক্কা দেয়—এই কী হয়েছে? এই—ভিতর থেকে উত্তর আসে না, কেবল বেসিনে জল পড়ে যাওয়ার শব্দ হতে থাকে।
দরজায় ধাক্কা দেয় মণিকা। এই, দরজাটা খোলোনা। কী হয়েছে তোমার? বমি করছ কেন?
সঞ্জয় উত্তর দেয় না।
মণিকা দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা দেয়—এই, কী হয়েছে? ওগো, দরজাটা খোলো না।
মণিকা চিৎকার করে ডাকে সুধা, এই সুধা—
সুধা দৌড়ে আসে—কী হল গো বউদি?
–দ্যাখো, তোমার দাদাবাবু দরজা খুলছে না। কী জানি কী হল, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেল নাকি?
শরীর খারাপ ছিল?
—হ্যাঁ, তুমি শিগগির বাড়িওয়ালাকে খবর দাও।
কিন্তু খবর দেওয়ার দরকার হয় না। ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়, দরজা খুলে দেয় সঞ্জয়। তার। দিকে তাকিয়ে মণিকা বিমূঢ় হয়ে যায়। অত বড় মানুষটাকে কেমন দুর্বল দেখাচ্ছে। ঠোঁট সাদা, মুখে রক্তাভা, চোখের দৃষ্টি খানিকটা ঘোলাটে। একটা হাত বাড়িয়ে সঞ্জয় বলে—ধরো আমাকে।