মণিকার বড় অভিমান হয়েছিল মনে-মনে। সে কি বাজিকরের দোকানের জিনিসের মতো হয়ে গেছে? সে কি লটারির পুরস্কার? তাদের এতদিনকার সম্পর্ক একটা হলুদ বেলুনের আয়ুর ওপর নির্ভর করবে অবশেষে? ছোট্ট একটু দুঃখ কাঁটার মতো ফুটল বুকে। ছোট্ট কাঁটা, কিন্তু তার মুখে বড় বিষ, বড় জ্বালা। মণিকার চোখভরে জলও কি আসেনি? এসেছিল। মুখ ফিরিয়ে সে সেই জলটুকু মুছে ছিল গোপনে। বলল—শোনো, আমি লটারির প্রাইজ নই। আমি তোমাকে পেতে চেয়েছি সমস্ত অন্তর দিয়ে। তোমাকে যে ভালোবাসি সে আমার পুজো। আমি কেন নিজেকে অত হালকা হতে দেব? তুমি চলো, ওই দোকানে যেও না। ও খেলা ভালো নয়।
কিন্তু সঞ্জয় বড় জেদি, ওই জেদই তাকে পুরুষ করেছে! ও জেদই মণিকাকে মুগ্ধ করেছে কত বার। সঞ্জয় মাথা নাড়াল। মুখে হাসি নিয়ে বলল—শোনো মণিকা, বেলুনটা আমি ঠিক ফাটাব।
—এসব নিয়ে খেলা কোরো না। চলে এসো।
–না, প্লিজ, তিনেট চান্স দাও।
মণিকা একটা শ্বাস ফেলল। তারপর আস্তে করে বলল, কিন্তু মনে রেখো, যদি না পারো এ বিয়ে হবে না।
—আমিও তো তাই বলছি!
মণিকার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। গলা ধরে যায় আবেগে। সঞ্জয়ের কাছে তার অস্তিত্ব কি এতই পলকা। যদি ও না পারে তবে সে ওর কাছে মিথ্যে হয়ে যাবে! এই সামান্য খেলায় সারা জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে তারা? মণিকা ইচ্ছে করলে সঞ্জয়কে টেনে আনতে পারত জোর করে, কিংবা কেঁদে-কেটে বায়না করে নিবৃত্ত করতে পারত, যেমন সে অন্য সময় করে। কিন্তু ওই সর্বনাশা মুহূর্তে হঠাৎ এক অহংকার-অভিমান-জেদ চেপে ধরল মণিকাকেও। তার জলভরা চোখ থেকে বিদ্যুৎ বর্ষিত হল। কান্নাটা চেপে রেখে সে বলল—বেশ।
দোকানি বন্দুক ভরে এগিয়ে দিল। সঞ্জয় বন্দুক তুলে একবার মণিকার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল—মাঝখানের ওই হলুদ বেলুনটা। বুঝলে লক্ষ করো।
–করছি। গম্ভীরভাবে বলে মণিকা।
সঞ্জয় কাঁধ পর্যন্ত বন্দুক তোলে। নিবিষ্ট মনে লক্ষ স্থির করতে থাকে। মণিকার একবার ইচ্ছে। হয়, বন্দুকটা ওর হাত থেকে টেনে নিয়ে পালিয়ে যায়। সে তৃষিত চোখে চেয়ে দেখছিল, সঞ্জয়ের দীর্ঘকায়, সুন্দর দেহটি। ধারাল মুখ। অবিন্যস্ত চুল নেমে এসেছে কপালে। ওই পুরুষ, আবাল্য পরিচিত মানুষটি একটু ভুলের জন্য চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে জীবন থেকে! এ কী ছেলেমানুষি!
ট্রিগার টিপল সঞ্জয়। শব্দটা ছড়াক করে মণিকার বুকে এসে ধাক্কা মারল। নড়িয়ে দিল তার দুর্বল হৃৎপিণ্ড। দেওয়াল ঘড়ির দোলকের মতো বুকে দুলতে থাকে। সঞ্জয় পারেনি। হ্যাঁ এবং না —এর ভিতরে, আলো আর অন্ধকারের ভিতরে, সুখ ও দুঃখের ভিতরে টিক-টিক-টিকটিক করে যাওয়া-আসা করে তার বুকের দেওয়াল ঘড়ির পেণ্ডুলাম। সে শুধু ফিসফিস করে বলে—আর মাত্র দুটো চান্স। দেখো, সাবধান।
সঞ্জয়ের মুখের হাসি মুছে গেছে। ভ্রূ কোঁচকানো। সে আবার বন্দুক নেয় দোকানির কাছ থেকে। তোলে। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ স্থির করে। কিন্তু মণিকা লক্ষ করে, ওর হাত কাঁপছে! বড় মায়া হয় মণিকার। সে বুঝল, এবারেও সঞ্জয় পারবে না, দু-চোখ ভরে আবার জল এল তার। ভাঙা কাচের ভিতর দিয়ে দেখলে যেমন অদ্ভুত দেখায় চারধারকে, তেমনি চোখের জলের ভিতর দিয়ে সে দেখতে পেল, রঙিন আলোর সুন্দর মেলাটি যেন ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। প্রতিবিম্বই বলে দিচ্ছে, এ-পৃথিবীর সুখ ভঙ্গুর, জীবন কত অনিশ্চিত।
সঞ্জয়ের হাওয়া-বন্দুকের শব্দ এবারও কাঁপিয়ে দিল মণিকাকে। সেইসঙ্গে যেন কেঁপে উঠল পৃথিবী, ভেঙে পড়ার আগে আর্তনাদ করে উঠল সমস্ত ভুবন। দ্রুত দোল খেতে লাগল বুকের দোলকটি, যেন বা খসে পড়ার আগে সে তার শেষ দোলায় দুলছে। এবারও লাগেনি।
সঞ্জয়ের মুখে রক্ত এসে জমা হয়েছে। ফেটে পড়ছে ভয়ঙ্কর মুখখানা। দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে উত্তেজনায়। তার ঠোঁট সাদা। দোকানি আবার বন্দুক ভরে এগিয়ে দেয়। নির্লিপ্ত গলায় বলে—এবার মারুন। ঠিক লাগবে।
–লাগবে? সঞ্জয় প্রশ্ন করে।
দোকানদার তো ভেতরের কথা কিছু জানে না। সে তাই ভালো মানুষের মতো বলে—আসলে মনটা স্থির করাই হচ্ছে সত্যিকারের টিপ। চোখ আর হাত তো মনের গোলাম। মনটাকে স্থির করুন, ঠিক লাগবে।
সঞ্জয় বন্দুকটা শেষবারের মতো হাতে নিল। তারপর মণিকার দিকে ফিরে চাপা গলায় ডাকল, মণিকা।
—উঁ!
–যদি না লাগে, তবে?
মণিকা শ্বাস ফেলে বলে, তুমি তো জানোই।
সঞ্জয় মাথা নেড়ে বলে—জানি, ঠিক। তাই একটা কথা বলেনি যদি না লাগে তবে আমাদের সম্পর্ক কবে থেকে শেষ হবে।
মণিকা ধীর গলায় বলল, আজ। এখন থেকে।
—আমরা একসঙ্গে ফিরব না?
—না।
—তুমি একা ফিরবে?
–হুঁ।
—আজ থেকে অন্য মানুষ হয়ে যাবে? আমার মণিকা আর থাকবে না তুমি?
—তুমিই তো ঠিক করেছ সেটা।
সঞ্জয় ম্লান একটু হেসে বলল, হ্যাঁ। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল—মণিকা, এবারও যদি না লাগে তবে আমাদের সম্পর্ক তো শেষ হয়ে যাবে। তবু তোমাকে বলিনি, আমি তোমাকে খুব, খুব, খুব ভালোবাসতাম। আর কখনও কাউকে এত ভালোবাসতে পারব না।
মণিকা রুমাল তুলে দাঁতে কামড়ে ধরল, তবু কি পারে দমকা কান্নাটাকে আটকাতে। কোনওক্রমে কেবল অসহায় একখানা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, শোনো।
–কী?
—শেষ চান্সটা থাক। মেরো না।