বেশ লাগছিল ভোরটা। কী বলব, এত সুন্দর দৃশ্যটা একা দেখছি। মনটা খাঁ–খাঁ করছে। কাকে যেন ডেকে দেখালে ভালো হত। আমরা একা কিছু উপভোগ করতে পারি না। ভালো লাগে না। বেঁচে থাকতে গেলে একজন প্রিয় মানুষ চাই। সে কি তুমি? বুঝতে পারি না। কিন্তু কাউকে বড্ড দরকার এক-বুক কথা জমে আছে।
মাকড়সার ক্ষুধা কী ভয়ঙ্কর! আজ দেখি, আধ–খাওয়া পিঁপড়েটার দেহাবশেষ নেই। মনটা বড় অস্থির লাগছে, কী করলুম! এই নিষ্ঠুরতা কি আমাকে মানায়!
দুপুরে জানালার পাশে জারুল গাছের ছায়া কোলে করে বসে আছি। কী একা, কী গভীর চারদিক। মনে হচ্ছে, আমার কে আছে! আমার কে আছে!
কোল জুড়ে জারুলের ছায়া, জীবনে যা কিছু জড়ো করেছি দু-হাতে, সবই আঁকড়ে ধরে আছি, সেসব কি ছায়ার মতো?
অথচ পৃথিবী কী গভীর। কত কোটি বছরের জীবনযাপনের সব চিহ্ন নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে তার প্রাচীনতার ঘ্রাণ। সব প্রাচীন সময়, সব প্রাচীন বাতাস আজও রয়ে গেছে। আমার চারধারে। এসব থেকেই জন্মেছি, এসবেই লয় পাবো। কোলে জারুলের ছায়া পড়ে, আলো দোলে। কিছুই ক্ষণিক নয়। সবকিছুই জন্মেছিল পৃথিবীর সঙ্গে।
জলে চোখ ভেসে গেল। স্মৃতিভ্রংশের মতো বসে থাকি। কোথা থেকেই বা এসেছি। ফিরে যাবই বা কোথায়!
সেই হাফহাতা পাঞ্জাবি পরা মানুষটা আসবে। উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছি। আমরা দুজনে উপত্যকা পেরিয়ে যাব। ওদিকে একটা ঘাসজমি, তারপর গাছগাছালি। যাব। ফিরব কি? কে জানে? ভেবো না। পৃথিবীতে কেউই খুব জরুরি নয়। যে যতই জরুরি ভাবুক নিজেকে, বা প্রিয়জনকে, তবু দেখো, তাকে ছাড়াও চলে যায়। কিছু অসুবিধে নেই। ছুটি দেবে? একবার দেখি হাওয়াটা পালটাতে পারি কিনা!
হাওয়া বন্দুক
দিন যায়। থাকে কথা।
মণিকার দিন যায়। কিন্তু কীভাবে যায় কেউ কি তা জানে? তার সুখের ধারণাও খুব বড় নয় দুঃখের ধারণাও নয় বড়। ছোট সুখ, ছোেট দুঃখে দিন তার কেটে যেত। বুকের মধ্যে প্রজাপতির মতো উড়ন্ত একটুখানি সুখ, বা ছোট্ট কাঁটার মতো একটু দুঃখ—এ তো থাকবেই। নইলে বেঁচে যে আছে তা বুঝবে কেমন করে মণিকা! কিন্তু সুখ-দুঃখের সেই ছোট ধারণা ভেঙে, দুয়ার খুলে বিশাল পুরুষের মতো অচেনা দুঃখ যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, যখন লুটেরার মতো দাবি করে সর্বস্ব, তখন সেই দুঃখ আকাশ বা সমুদ্রের মতো ভুবন-ব্যাপ্ত বিশালতার ধারণা নিয়ে আসে। মণিকার দুর্বল মাথায় তা যেন ধরে না।
গড়ের মাঠে শীতের মেলায় তারা হেঁটেছিল দুজনে। তখন টুকুন ছিল না। সঞ্জয়ের সঙ্গে তখনও তার বিয়ে হয়নি। চুরি-করা দুর্লভ বিকেলে তারা ওইরকম বেরোতে পারত। সঞ্জয় অফিস থেকে বেরিয়ে আসত, মণিকা পালাত কলেজ থেকে। একদিন তেমনি তারা গিয়েছিল শীতের মেলায়। মেলায় ছিল রঙিন আলো, সজ্জিত মানুষের ভিড়—নাগরদোলা, লক্ষ্যভেদের দোকান। ছিল ধুলো, শীতের বাতাস আর ছিল রোমহর্ষ। বিষণ্ণতা কোথাও ছিল না।
লক্ষ্যভেদের দোকানে চক্রাকারে সাজানো বেলুন, ঝুলন্ত খেলনা, বল, দোকানি ডাকছে–
—প্রতি শট পাঁচ পয়সা, আসুন, হাতের টিপ দেখে নিন।
সঞ্জয় দাঁড়ায়।
—মণিকা, হাতের টিপ দেখি?
মণিকা—কী হবে ছাই! হাতের টিপ দেখে!
—দেখিই না, যদি অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ করতে পারি।
—তাহলে কী হবে?
অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে কী যেন পেয়েছিল!
–দ্রৌপদী।
—আমিও পাব মণিকাকে।
—পেয়ে তো গেছই। সবাই জানে আমাদের বিয়ে হবে।
সঞ্জয় একটা শ্বাস ফেলে বলে, মণিকা তোমাকে বড় সহজে পেয়ে গেছি আমি। ঠিক। ডুয়েল লড়তে হয়নি, যুদ্ধ করতে হয়নি, মা-বাবা বাধা দেয়নি। কিন্তু এত সহজে কিছু কি পাওয়া ভালো? মণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলে, ভালো নয়, তবে তুমি কি চাও তোমার-আমার মধ্যে বাধাবিঘ্ন আসুক?
-না-না, তা নয়।
—তবে কি তুমি আমাকে মোটেই চাও না আমি সহজলভ্যাবলে?
—তাও নয়। তোমাকে চাই। কিছু এত সহজে নয়। সহজে কিছু পেলে মনে হয় পাওয়াটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না। জয়ের আনন্দই আলাদা।
মণিকা হাসল। বলল—তবে বরং আমি কিছুদিনের জন্য অন্য পুরুষের প্রেমে পড়ে যাই! কিংবা চলে যাই দু-বছরের জন্য দিল্লির মাসির বাড়িতে, বিএ পরীক্ষাটা না হয় ওখানেই দেব। নইলে চলো, ঘুমের ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকি। তুমি অনেক ঝামেলা-টামেলা করে আমাকে ফের বাঁচিয়ে তোলো। তাতে বেশ দুর্লভ হয়ে উঠি আমি।
সঞ্জয় মৃদু হেসে বলে—না, না, অতটা করার কিছু নেই। বরং ওই টারগেটের দোকানে চলো। একটা বেলুন দেখিয়ে দাও। আমি ফাটাব।
—ফাটালে কী হবে?
—তোমাকে জয় করা হবে।
–না পারলে?
—জয় করা হবে না।
—তাহলে আমাদের বিয়েও হবে না?
সঞ্জয় মাথা নেড়ে বলল–না।
–বাবা, তাহলে আমি ওর মধ্যে নেই। আমি সবকিছু সহজে পেতে ভালোবাসি। সঞ্জয় তার হাতখানা ধরল। বলল—মণিকা।
—উঁ।
—ওই যে মাঝখানের হলুদ রঙের বেলুনটা, ওটাকে ফাটাব। তিন চান্সে।
–যদি না পারো?
–না পারলে—
কথা শেষ করে না সঞ্জয়?
–পারলে?
—বিয়ে হবে না।
মণিকা খুব গম্ভীর হয়ে বলল, শোনো।
–কী?
—তুমি ইয়ার্কি করছ?
—না।
—সিরিয়াস।
—ভীষণ!
মণিকা শ্বাস ছেড়ে বলে,—তুমি ভীষণ জেদি। পুরুষমানুষের জেদ থাকা ভালো, কিন্তু যার ওপর আমাদের মরণ-বাঁচন তা নিয়ে তোমার খেলা কেন?
সঞ্জয় কাতর স্বরে বলে,—মণিকা, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই তোমার-আমার ভাব। পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছি। বড় হতে-হতেই জেনে গেছি তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। কত সহজ ব্যাপারটা বলো তো! কোনও রহস্য নেই, রোমাঞ্চ নেই; প্রতিযোগিতা নেই। এ কেমন পাওয়া। আজকের দিনটাই একটু ক্ষণের জন্য এসো একটু দুর্লভ হই। কিছুক্ষণ অনিশ্চয়তা খেলা করুক আমাদের সম্পর্কের মধ্যে।