মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অস্থিরতা ছিল না। প্রকাণ্ড আকাশের তলায়। ধারোয়ার মস্ত উপত্যকায় বসে থেকে একরকমের মহৎ বিষণ্ণতা টের পাচ্ছিলাম। চলে যাওয়াটাই অমোঘ।
নদীর ধার ধরে একটা লোক উঠে এল। ঝোপে ঝাড়ে কী যেন খুঁজছে। কোনও বুনন লতাপাতা হবে। তার গায়ে একটা হাফহাতা পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি, বেশ তেজস্বী চেহারা। দেহাতিই হবে।
সেই ভেবে লোকটাকে ডেকে বললুম–ক্যায়া ঢ়ুঁড় রহে হৈ জী?
লোকটা একপলক তাকিয়ে একটু হাসল। কাছে এসে বলল –আপনাকে দেখেছি এখানে কয়েকদিন। বাঙালি তো?
বললুম–আজ্ঞে। আপনি এখানেই থাকেন?
–বহুদিন হয়ে গেল। ছেচল্লিশ সালের পর থেকেই।
বসল। অনেকক্ষণ দু-পক্ষের পরিচয় হল। বেশ লোকটা। পঞ্চাশের ওপর বয়স, কিন্তু সেটা উনি না বললে কিছুতেই বুঝতে পারতুম না, একদম ছেলেমানুষি চেহারা। চাউনিতে এখনও বেশ একটা জীবনীশক্তি। কথায় কথায় বললেন–বয়েস কমানোর ওষুধ জানি না। সারাদিন খাঁটি, ঘুরি, ঘুমোই মাত্র চারঘণ্টা। আহার, নিরামিষ ডালভাত স্বপাকে।
লোকটা ধার্মিক। তাঁর ইষ্টদেবের আশ্রমে থাকেন। তাঁর কাজে জীবন উৎসর্গ করেছেন। একসময়ে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, নিজের গাড়িটাড়ি ছিল, লম্বা বেতন পেতেন। সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন, কোনও ক্ষোভ নেই।
জিগ্যেস করলুম–ঘর সংসারের কথা ভাবেন না? চলে কীসে?
উনি বললেন–সংসারের সবাই তো এখানেই, ভাবব কেন? ভাবছ তুমি চলবে কীসে, ভাববার তুমি কে? ভাববার যিনি, ভাবছেন তিনি, ভাবো তুমি তাঁকে। এই ছোট্ট ছড়াটা বলে হাসলেন।
রাত হয়ে গিয়েছিল, উনি অন্ধকার রাস্তায় আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন, আমি ডেকে একটু বসালাম। উনি চা খান না, অন্যের বাড়িতে আহার্য গ্রহণ করেন না। কী দিয়ে আপ্যায়ন করি! ভারী কাঠখোট্টা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে, এ লোকটা।
যাওয়ার আগে লোকটা হঠাৎ বলল –কোনও অসুবিধে নেই তো?
–না, না। বেশ আছি।
লোকটা চারদিক ঘুরে-ঘুরে ঘরদোর দেখল। বলল –আপনি মশাই ঘোরতর স্ত্রৈণ লোক তো, স্ত্রীকে ছেড়ে একা এখানে এসেছেন কেন?
প্রশ্নটা চেপে গিয়ে বললাম–কী করে বুঝলেন যে আমি স্ত্রৈণ?
–ঘরদোরের অবস্থা দেখে, ছাড়া জামাকাপড় গুছিয়ে রাখার অভ্যাস নেই, বিছানায় ঢাকনা দেননি, গেঞ্জি কাঁচা নয়। লক্ষণ দেখলে চেনা যায়। বোধহয় আপনি একটু ভাবুক মানুষও। বলে তিনি চকচকে চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আবার ছড়া বললেন–অর্জনে পটু, সাশ্রয়ী। কাজে, সুন্দরে সমাপন, এই দেখেই বুঝবি রে তার যোগ্যতা কেমন।
বেশ লাগল লোকটাকে, এখানে আমার পর থেকে কেমন একটি দুটি সহজ দার্শনিকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। শিখছি। কলকাতায় এরকম মানুষ বড় একটা পাইনা।
.
আমার পালে মৃত্যুর হাওয়া লেগেছে। তরতর করে ভাঁটিয়ে যাচ্ছে নৌকা। কাল বিকেলে একটা মৃত্যু দেখলুম।
আমার উঠোনের ধারে একটু বারান্দা আছে। তার কোলে একটা তারাফুলের মরা ঝোঁপ। একটা মাকড়সা জাল ফেঁদে বসে থাকে, রোজ দেখি। পোকামাকড় পড়লেই জাল নড়ে ওঠে। মাকড়সাটা জালের কাঁপুনি টের পায়। তারপর নির্ভুল লম্বা-লম্বা আটটা পায়ে দুলে–দুলে হেঁটে এসে পোকা ধরে। বিকেলে ওই বারান্দায় বসে মাকড়সার জালটা দেখছিলুম। হরিয়া একবাটি মুড়ি তেল দিয়ে মেখে দিয়ে গেছে, বসে খাচ্ছি। হঠাৎ ভাবলুম, মাকড়সাটাকে নিয়ে একটু খেলা করি। একটা মুড়ির দানা তার জালে ছুঁড়ে দিলুম, মুড়িটা আঠালো জালে পড়ে আটকে গেল। কাঁপুনি টের পেল মাকড়সা। একটু চুপ করে থেকে লম্বা পায়ে ধীরে হেঁটে এল। শুকল, দেখল। তারপর একটা লাথি মেরে মুড়ির দানাটা ফেলে দিল জাল থেকে। আবার ফিরে গেল জালের মাঝখানটিতে, ধৈর্য ধরে রইল জেলেদের মতো। আবার মুড়ি ছুঁড়ে মারলুম। আবার উঠে এল। দেখল, কল, লাথি মেরে মুড়ি ফেলে দিয়ে জালটাকে পরিষ্কার করে চলে গেল। বার বার এই কাণ্ড। বেশ খেলাটা। মাকড়সারা যে মুড়ি টুড়ি খায় না তা বুঝতে পারলুম কাল, খায় না কেন বলো তো?
সে যাকগে, অনেকক্ষণ ধরে মাকড়সার জালে মুড়ি ছুড়বার খেলা খেলে ক্লান্ত লাগছিল। হঠাৎ ইচ্ছে হল দেখি, রক্তমাংসের গন্ধ পেলে খায় কিনা। উঠোনের একধারে বিশাল হিংস্র চেহারার পিপড়ে দেখেছি। তাদের মস্ত মাথা, মিশমিশে কালো। তখনও দু-একটা ঘোরাফেরা করছিল উঠোনে। রান্নাঘর থেকে চিমটে এনে তাদের একটাকে ধরে জালে ছেড়ে দিলুম। মুড়ি খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, বেড়াতে যাব, তাই আর ফলাফলের অপেক্ষা করিনি। ফিরে এসে দেখি মস্ত পিঁপড়েটা জালের কেন্দ্রে মাকড়সাটার খুব কাছেই মরে আটকে আছে। শরীরটা অর্ধেক খাওয়া।
মনটা সেই থেকে খারাপ। কেবলই ভাবছি, এ পাপ আমাকে কি স্পর্শ করবে?
পালে মৃত্যুর হাওয়া লেগেছে, নৌকো ভাঁটিয়ে যাচ্ছে। উজানেরও হাওয়া আছে, বাইলে উজানেও যাওয়া যায়। আমি পারছি না। এবার চিঠিতে লিখেছ আমাকে ফিরে যেতে। ভুলে যাও কেন যে আমি হাওয়া বদল করতে এসেছি। এখনও হাওয়া বদল শেষ হয়নি তো। মৃত্যুর হাওয়ার বদলে জীবনের হাওয়া লাগুক।
আজ ঘুম পাচ্ছে। এ চিঠিটা আবার কাল শেষ করব।
.
ঘুম থেকে উঠেই দেখি, কী সুন্দর ভোরের আলোটি। দিন আসছে, তারই আবাহনে আকাশ মর্ত জুড়ে কী মহা আয়োজন! আকাশে মেঘ ছিল না, ধুলো–ধোঁয়া ছিল না, গাছগাছালি শান্ত, বাতাস মৃদু। রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি যেন পিঁপড়েদের জগতে চলে যাচ্ছি। লক্ষ পিঁপড়ে আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন? কিন্তু ভোরে ঘুম ভাঙল কুটুস একটা কামড়ে। উঠে দেখলুম। পিঁপড়ে নয়, বড্ড ছারপোকা।