জানি এ চিঠি পেলে তুমি হয়তো আরও অস্থির হয়ে পড়বে। কিন্তু আর তোমার মতো বিশ্বস্ত কেউ নেই যাকে এসব লেখা যায়। সবকিছুই ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিল আমাদের, তাই আমিও চাই আমার অস্থিরতার এইটুকু তোমার ভিতরে সঞ্চারিত হোক।
.
আজ সকালে চিঠিটা শেষ করিনি, ভেবেছিলাম বিকেলে করব। তাই করছি। আজ বিকেলে বুধুয়া এসেছিল তার সেই গুণীকে নিয়ে। গুণীকে যেমন কল্পনা করেছিলুম তেমন নয়, অর্থাৎ তার একহাতে ঝাঁটা অন্যহাতে সর্ষেপোড়া নেই এবং চোখ রক্তবর্ণও নয়। নিরীহ ভালোমানুষের মতো চেহারা, কথাবার্তায় মনে হয় বেশ কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে। বয়সও তার অল্প, বোধহয় তিরিশ। ‘আপনি’ বা ‘তুমি’ কোনটা বলব তা নিয়ে একটু গোলে পড়লুম, শেষে ‘আপনি’ই বলতে লাগলুম। সে একসময়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল –আপনার অসুখটা তো মনের।
বললুম, কী করে বুঝলেন?
হেসে বলল –বোঝা যায়। আপনার চোখ সে কথাই বলছে। তারপর আবার খানিক চেয়ে থেকে বলল –আপনার ছেলেমেয়ে দুটি এবং আপনার স্ত্রী আপনাকে খুবই ভালোবাসে, কিন্তু আমার মনে হয় তারা আপনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারে না।
বোঝো কাণ্ড! তোমরা তো নিশ্চিন্তে আছ, কিন্তু এদিকে তোমাদের মনের কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। একটু চমকে উঠেছিলুম, তবু হাসিমুখে জিগ্যেস করি–আমার দুই ছেলেমেয়ে আর। একটি স্ত্রী কী করে বুঝলেন? মন্ত্রবলে নাকি?
আবার হাসল–না, বুধুয়া বলছিল আমাকে।
মনে মনেই হো–হো করে হাসলাম। এরা কি তোমাকে বন্ধ্যা মনে করে? বুধুয়া চলে আসার পরও তো এক বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে যদি আর একটি হত সে কি হিসাবের বাইরে থাকত। নাঃ, পৃথিবীতে হঠযোগ, মন্ত্র–তন্ত্র এসব কিছুই নেই দেখছি। না থাকলে তো আমারই মুশকিল, কেননা আমাকে অবিলম্বে এই ধরনের একটা আশ্রয় পেতেই হবে, নইলে সেই পুরোনো ভাবনা, চিন্তাগুলো আবার এসে জাপটে ধরবে।
গুণী বলল –বুধুয়া আপনার কথা সবই বলেছে আমাকে। ও আপনাকে খুব ভালোবাসে। বুধুয়া লজ্জায় মুখ লুকোল, আমি একটু হাসলুম, কিছু বললুম না। গুণী খানিকক্ষণ আবার চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল –মনের যে অশান্তি রয়েছে তা সাধারণত কামনাবাসনা থেকে আসে। আপনি বড় বেশি চান।
মিথ্যে বলব না, এসব পুরোনো কথায় একটু বিরক্ত হয়েছিলুম। বললুম–কামনা-বাসনা ছাড়া মানুষ হয় না।
সে তেমনি শান্ত গলায় বলল –কিন্তু আপনি চান আরও বেশি। আপনি সুখের চেয়েও বেশি কিছু চান, সে হল শক্তি শান্তি সন্তোষ। এটাই পাওয়া সবচেয়ে কঠিন, এ চাওয়াই সবচেয়ে বড় চাওয়া।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলুম।
সে বলল –আপনি ঈশ্বরে মন দিন। তাঁর দয়া পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি দয়া করেন।
হেসে বলি–ঈশ্বরের দয়াকে বিশ্বাস কী করে করব? ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই যে!
সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল –আপনার প্রিয়জন আছেন জানি, কিন্তু আপনি তাঁদের কতটা ভালোবাসেন? তাঁদের জন্য প্রাণ দিতে পারেন?
একটু হকচকিয়ে গিয়ে থমকে একটু ভেবে বললুম–বোবাধহয় পারি। তোমাদের তিনজনের মুখ ভেবে নিয়ে পারি’ বলতে ভালোই লাগছিল–যেন সত্যিই পারি।
লোকটা একবার একটু ধোঁয়াটেভাবে বলল –ভালো করে ভেবে দেখবেন। যদি সত্যিই পারেন, এবং ভালোবাসার জন্যেই পারেন তবে আপনি সব অশান্তি কাটিয়ে উঠবেন!
এরপর ওরা চলে গেল। সাইকোথেরাপির এই গ্রাম্য চেষ্টা দেখে খুব হাসলুম নিজেই।
এবার চিঠি শেষ করি। খুকুকে বোলো ওর কাঁচা হাতের লেখা চিঠিটা পেয়েছি। কিন্তু ওর ভাষাটাও তোমার বলে মনে হল, সে লিখেছে ‘বাপি, তুমি অত ভেবো না।’ তুমি ওদের কিছু বোলো না, দোহাই, ওরা যা চায় তাই লিখুক। আমি ওদের মনটাকে স্পষ্ট ধরতে চাই।
.
ধারোয়া নদীর ধার তুমি তো দ্যাখোনি! কী সুন্দর! উপত্যকার মতো বহুদুর পর্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে গেছে। মাটি শুকনো, গেরুয়া রঙের। কোথাও মাটি রক্তের মতো লাল। মস্ত পাথরের চাঁই। মাটিতে গাঁথা। বিকেলের দিকটায় অসহ্য নির্জনতা। হাঁটছি তো হাঁটছিই। শেষবেলার আলোয় আমার মস্ত ছায়াটা কত দীর্ঘ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। ছায়াটার পিছু পিছু হাঁটছিলাম। যদি আমার ছায়াটার কোনও ইচ্ছাশক্তি থেকে থাকে, যদি থাকে নিজস্ব সত্তা তো নিয়ে যাক আমায় যেখানে তার খুশি। এও এক খেলা। ছায়াটা সব বন্ধুরতা অবলীলায় পার হয়। মস্ত পাথরের চাঙড়, গর্ত, গাছপালা কিছুই তাকে বাধা দিতে পারে না। শরীরী পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। শরীরটা যে মস্ত বাধা।
এলোপাথারি হাঁটতে-হাঁটতে হাঁফ ধরে গেল। নদীর ধার পর্যন্ত পৌঁছোতে সন্ধে লেগে গেল প্রায়। নদীর ধারে চুপটি করে বসে রইলাম। একটুখানি আলো আর বাকি আছে মাত্র। খুব একটুখানি। চারধারের গাছপালা, মাঠ, নদীর জল তৃষ্ণার্তের মতো সেই শেষ আলোটুকু শুষে নিচ্ছে। দেখতে-দেখতে পৃথিবীকে বড্ড অনিত্য বলে মনে হয়। দিনটা যে গেল, এইভাবে রোজ যায়। থাকে না তো। একটা স্থির সূর্য যদি কেউ আকাশে লাগিয়ে রাখত, তবে কি আমাদের দিন যেত না? বয়স বাড়ত না। যেমন ছিলাম সবাই, তেমনি চিরকাল থেকে যেতাম! ওই যে গতিময় ধারোয়ার জল বয়ে যাচ্ছে, ওর মধ্যেও সেই অনিত্যতার কথা। বয়ে যাচ্ছে। আজ যে এক কোষ জল বয়ে গেল, সে গেল চিরকালের মতোই। ধারোয়া বেয়ে সে আর কোনওদিনই যাবে না এক গতিপথে।