এখনও জলের ঝরে পড়বার শব্দ, ব্যাঙের অবিরাম ডাক শুনতে পাচ্ছি। তুমি হয়তো ঠিক বুঝতে চাইবে না, কিন্তু এখানে আসবার পর যত বার রাত্রিতে বৃষ্টির শব্দ শুনেছি আমি, ততবার মনে হয়েছে যে আমার একটা পূর্বজন্ম ছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না যে, এজন্মেই আমার শুরু ও শেষ। রহস্যের কথা যে বলেছিলুম তা এই। বোধহয় এইসব অনুভুতির কোনও মূল্যও নেই। না থাক, তবু আমার কাছে আজ বৃষ্টি যে প্রিয়, ঘাস, ফুল, মাটি যে প্রিয়, তার কারণ হয়ে থাক এই রহস্যময় অনুভূতিগুলি। আমি কখনও এ রহস্যের অবসান চাইব না।
দ্যাখো, বৃষ্টি এসেছে বলেই আমার বাগানের গাছগুলোর ওরকম আনন্দ, তারা বাহু মেলে শিকড় ছেঁড়া কাঁপনে কাঁপছে। এই যে ব্যাঙের ডাক, জলের শব্দ শুনছি তাতেও কেমন এক আনন্দের সুর লেগেছে। মনে হয় আবহমান কাল থেকে আমাদের এই বৃক্ষলতাগুল্ম, ওই আপাততুচ্ছ ব্যাঙগুলো এই বৃষ্টিকে পৃথিবীতে ডেকে আনছে। তাই বৃষ্টির ভিতরে কেমন একটা ভালোবাসার গন্ধ হয়েছে। এ না হলে ও হয় না, ও না হলে এ হয় না, ভেবে দেখলে, আমরা সবাই যেন এরকম একটা টানক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছি।
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে চিঠিটার সুর কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। এভাবে কেউ বউকে চিঠি লেখে? কী করে জানব। বারবার তুমি আমার হাতের কাছেই ছিলে, চিঠি লেখবার দরকার হয়নি তো কখনও। মনে হচ্ছে চিঠির শেষে ঘর–সংসারের কথা কিছু লেখা দরকার। তুমি কেমন আছ আমাকে ছেড়ে তা জানতে ইচ্ছে করছে। শমীক আর খুকু বরাবর আমাকে একটু গম্ভীর বলে জানে, বড় একটা কাছে ঘেঁষে না। ভাবছি এবার ফিরে গিয়ে ওদের সঙ্গে একটু বেশি করে মিশব। কী বলে?
.
তোমার একজোড়া চিঠি পেলুম আজ। দ্বিতীয়টা এক্সপ্রেসে এসে প্রথমটাকে ধরেছে। বুঝতে পারছি আমার চিঠি পেয়ে একটু অস্থির হয়েছ। আরও বোঝা যাচ্ছে যে আমার শরীরের জন্য তোমার উৎকণ্ঠা তেমন নেই, যতটা আমার মানসিক অবস্থার জন্য আছে। সন্দেহ হচ্ছে কি যে আমার মাথায় কেমন যেন একটু…? সন্দেহ মাঝে-মাঝে আমারও হয়। এতকাল সেই বাসে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার কাছে সবটাই ছিল একটা খেলার মাঠের মতো–যেখানে
দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট দিনের আলোয় আমার প্রতিপক্ষ সব খেলোয়াড়কেই দেখতে পাচ্ছি, সহযোগীদেরও চিনে নিচ্ছি। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসবার পর থেকে দেখছি দিনের আলোয় সেই মাঠ যতটা স্পষ্ট মনে হয়েছিল এখন আর ততটা নয়। সেই মাঠে যেন এক নিস্তেজ শেষবেলার আলো পড়েছে, বহুদুর প্রায় সীমারেখাহীন হয়ে বিস্তৃত হয়েছে সেই মাঠ, দূরে–দুরে অস্পষ্ট চেহারা নিয়ে কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে তাদের চেনা যাচ্ছে না। সব কেমন যেন পালটে গেল।
তুমি ঠাট্টার ছলে প্রশ্ন করেছ আমি কবি হয়ে যাচ্ছি কিনা। তুমি তো গোঁড়া ঈশ্বরবিশ্বাসী, তুমি কি বিশ্বাস করো না যে, ঈশ্বর সবকিছুর এবং এমনকী নিজেরও সৃষ্টিকর্তা? তাঁর চেয়ে বেশি। কল্পনাপ্রবণ প্রকাশক্ষমতা আর কার থাকতে পারে, তাঁর চেয়ে বড় কবি কে? আর যেহেতু তাঁর। সেই আনন্দময় কবিসত্তা থেকে আমাদের আত্মার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমাদের জনমত রয়েছে, সেই হেতু আমাদের সকলেরই কিছু পরিমাণে কবি হওয়া বাধ্যতামূলক। কোন মানুষ, কোন বৃক্ষ, কোন পশু কবি নয়? আমার মাঝে-মাঝে মনে হয় কী জানো? আমি যে ইজিচেয়ারে শুয়ে নানা কথা ভাবলুম আমার সেইসব চিন্তাভাবনার ঢেউ ইজিচেয়ারটা ধরে রেখেছিল–ঠিক টেপরেকর্ডারের মতো। অন্য কেউ যখন এসে সেই ইজিচেয়ারে বসবে তখন ইজিচেয়ারটা সেই ঢেউগুলি বিকিরণ করবে তার বোধ ও বুদ্ধির ভিতর। চমকে উঠো না। ইজিচেয়ারটাকে ওরকম ভাবতে যদি অস্বস্তি হয় তবে সে জায়গায় বাতাস, মাটি, জল কিংবা শূন্যতা ভেবে নিতে পারো। যেমন এই ধরনের কোনও মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যদি আমার গভীর ও গোপন ভাবনা-চিন্তা ও বোধ অন্যের ভিতরে সঞ্চারিত হত। যদি আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলি এভাবে ভাষায় প্রকাশ করতে না হত আমরা কাউকে কবি বলতুম না, বুঝতুম যে এক ভয়ঙ্কর, উন্মত্ত ও দুর্বার কল্পনাশক্তি থেকে আমাদের সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা সকলেই কিছু কিছু কবি। কাল রাত্রেও অনিদ্রা পেয়ে বসেছিল, মাঝে-মাঝে ওইটাই বড় যন্ত্রণা দেয়। কেমন পিপাসা, ভয়, উল্কণ্ঠার এক সংমিশ্রণে শুয়ে ছিলুম গভীর রাত অবধি। তখন বৃষ্টি থেমে জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাইরে শুনলুম কুকুর কাঁদছে চাঁদের দিকে চেয়ে থেকে। শিউরে উঠে একবার হরিয়াকে ডাকতে গেলুম, কিন্তু ডাকা হল না। চোখ বুজে আমি শুনতে পেলুম কুকুরের সেই কান্নার সাথে ডানা। ঝাঁপটানোর প্রাণপণ শব্দ উঠছে। অনেকক্ষণ চোখ বুজে রইলুম–বোধ হল সবটাই মনের ভুল–কেউ কাঁদছে না, কেউই উড়ে যেতে চাইছে না। তারপর ক্রমে আস্তে-আস্তে বুঝতে পারছিলুম অকারণ চোখের জলে চোখ ভরে আসছে। যেন আমি আর ঘরে নেই, নিশিরাতের পরী আমাকে উড়িয়ে এনেছে, শুইয়ে দিয়ে গেছে শিশিরে ভেজা মাঠের ওপর স্নান জ্যোৎস্নার ভিতরে। চোখ চেয়ে দেখব দুটো সাদা হাঁস মলিন জ্যোৎস্নাকে গায়ে মেখে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সীমারেখা ছেড়ে দূর–নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে, কিংবা আরও দুরে, যার কোনও সীমারেখা নেই এমন সমুদ্রের সন্ধানে তারা চলেছে–আর কখনও ফিরে আসবে না। হাঁসের ঘর ভেঙে রক্তমাখা মুখে, গায়ের। পালক ঝেড়ে কুকুরটা তাই এসেছে মাঠে দূরতম সেইসব হাঁসের সন্ধানে, তারপর চাঁদ ও শূন্যতা দেখে কাঁদছে। আমার চোখের ওপর গভীর স্বপ্নের সেই খেলা চলল অনেকক্ষণ।