আমি হেসে বললুম–আনিস লোকটাকে আলাপ করে দেখব। রোগ কিছু নেই, তবু এখানে এসে নতুন ধরনের লোকের সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বুধুয়ার বোধহয় ধারণা আমার অসুখটা শক্ত ধরনের তাই সে যাওয়ার সময় মাথা ঝাঁকিয়ে বারবার ভরসা দিয়ে বলে গেল যে অনেক শক্ত রোগ সেই গুণী সারিয়েছে।
বুধুয়া চলে গেলে অনেকক্ষণ একা-একা বসে ভাবলুম। বুধুয়ার ধারণা যে ভুল তা মনে হচ্ছিল। কখনও বলিনি তোমাকে, যেদিন অফিসে যেতে গিয়ে বাসের মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে গেলুম। সেদিনটায় প্রথমে মনে হয়েছিল নিশ্চিত এটা করোনারি অ্যাটাক। জ্ঞান ফিরে এলে মনে হয়েছিল আমি হয়তো তিন-চারদিন বা আরও বেশি দিন অজ্ঞান হয়েছিলুম। ক্রমে বুঝতে পারলুম যে এটা ব্লাডপ্রেসার, এবং মাত্র ঘণ্টা দেড়েক আমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলুম তখন আমার ভয় কেটে যাওয়া উচিত ছিল। ডাক্তারও অভয় দিচ্ছিল–আমার বয়স মাত্র তেতাল্লিশ, স্বাস্থ্য ভালো–ভয় কী? এখনও একটা জীবন সামনে পড়ে আছে। কিন্তু কেন জানি না ওর পর থেকেই মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেল। আগে তো কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি রাস্তায়, ট্রামে–বাসে সব লোক দিব্যি চলাফেরা করছে, মাঝখান থেকে হঠাৎ আমিই অজ্ঞান হয়ে গেলাম কেন? এইসব ভেবে ভেবে কয়েকদিন নিজেকে খুব দুর্বল আর অসহায় মনে হতে লাগল। এতকাল কখনও খুব গুরুত্ব দিয়ে বয়স হয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি, মরার কথা ভাবিনি। এবার ভাবতে লাগলুম। ভেবে দেখলুম দুটোর কোনওটাকেই তো আমি এড়াতে পারব না। কলকাতায় হাঁপ ধরে গেল। মনে হল। বহুকাল কলকাতার বাইরে যাইনি, এতদিন একজায়গায় থেকে মনটা নিস্তেজ, আর নানা বাজে ভাবনার বাসা হয়ে উঠেছে। তাই তোমাকে একদিন বলেছিলাম–চলো বাইরে কোথাও থেকে দু-চারদিন বেড়িয়ে আসি। তুমি অবাক হয়ে বললে–ও মা! ভূতের মুখে রামনাম! এতদিন তো উলটো গেয়েছ। শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়েছিলুম। বাস্তবিক অফিসে আমার ছুটি জমে–জমে পচে গেল, বেড়িয়ে আসা দূরের কথা, একদিন ছুটি নিয়ে বসে থাকতেও ইচ্ছে হয়নি। বেড়াতেই বা কোথায় যাব! কিন্তু কলকাতা কয়েকদিনেই অসহ্য হয়ে গেল। দু-একদিন শমীক আর খুকুকে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে গেলুম–ওরাও বাবার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক। কিন্তু এভাবেও আমার বিষণ্ণতা কাটল না। মনে হল দূরে কোথাও যাওয়া একান্ত দরকার, আর যেতে হবে একলা। একলা হলেই নিজের মনটাকে সুবিধে মতো পাওয়া যাবে, তখন দেখা যাবে তার কোথায় কোন কাঁটাটা বিঁধে আছে। শুধু তোমাকে নিয়ে আসা যায় না, তাহলে শমীক আর খুকুকে কে দেখবে? ওদের নিয়ে এলে আবার স্কুল কামাই হয়। একা আসতে প্রথমটায় খারাপ লাগছিল, এখানে এসে কয়েকদিন ভীষণ মনখারাপ লাগল–আগের চিঠিতে সেসব জানাইনি। এমনকী তিনদিন পর একদিন ফিরে যাওয়ার জন্য সব বাঁধাছাঁদা করে ট্রেনে পর্যন্ত উঠে পড়েছিলুম। মধুপুরে ট্রেন থামতে মনে হল বড় নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা–তা ছাড়া সন্দেহ হল কলকাতায় গেলেই সেই বিশ্রী ভাবনাগুলো আবার ঘাড়ে চেপে বসবে। মধুপুরেই নেমে পড়া গেল, কিন্তু দেওঘরেও ফিরতে ইচ্ছে হল; ওখানে না থেকে হরিয়াকে দেওঘরে ফেরত পাঠিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লুম। সাতদিন ধরে নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। কোনও লক্ষ স্থির ছিল না, সহযাত্রীদের কাছে যে জায়গার নাম শুনেছি সে জায়গারই টিকিট কেটেছি পরদিন। ভালো করে খাওয়া হয়নি, শোয়া হয়নি, গালে দাড়ি বেড়ে গেছে, শরীর পথের ধকলে দুর্বল তবু ওই সাতদিনে মনের জড়তা কেটে গেল, তাজা লাগল নিজেকে, দেওঘর ফিরেছি দিন চারেক হল। এখন আর খারাপ লাগছিল না। তোমাদের কথা খুব একটা মনে পড়ছিল না।
শুধু বুধুয়া এসে মনটা খারাপ করে দিয়ে গেল। সেই যে ওকে কবে একটু ভালোবেসেছিলুম, ও আসায় সেই ভালোবাসার জায়গায় আবার হাত পড়ে গেল। কাল থেকে আবার তোমাদের কথা তাই ভীষণ মনে পড়ছে। বুধুয়া না এলে এটা হত না। বুধুয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারটার সম্পর্ক হয়তো তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। আমিও পারছি না, কেবল মনে হচ্ছে কী রকম অস্পষ্ট একটা যোগাযোগ হয়েছিল।
.
আজ তোমাকে কোনও চিঠি লিখবার কথা ছিল না। এই তো তিনদিন হয় তোমাকে চিঠি লিখেছি, এখনও জবাব দাওনি, কিংবা হয়তো তোমার চিঠিও এখন মাঝপথে। তবু লিখতে বসেছি, মনে হচ্ছে তোমাকে কী একটা বিষয় যেন জানাবার আছে, যা রহস্যময় যা অস্পষ্ট। ভয় পেও না-এ তেমন কিছু নয়। আজ বিকেল থেকে মনটা ডানা মেলেছে, উড়ছে, কোনও ঠাঁই ছুঁতে চাইছে না। বিকেলে আকাশ ঘনঘোর করে এল, বেড়াতে গিয়েছিলুম মেঘ দেখে বৃষ্টি আসবার আগেই ঘরে ফিরে এলুম, তারপর ইজিচেয়ারে রোজকার মতো না বসে দরজার চৌকাঠের পাশটিতে বসে রইলুম চুপ করে। বৃষ্টি এল। ঘন মেঘের স্নিগ্ধ ছায়া পড়েছে চারধারে, বর্ষার ব্যাং ডাকছে, ঝরঝর জলের শব্দ হয়ে যেতে লাগল। আর কোনও শব্দ নেই। সামনে বাগানে ফুলগাছগুলো, পাতাবাহারের গাছগুলো অঝোর জলধারায় ভিজে যাচ্ছিল। আমার ছোট্ট বাগানটায় গভীর ভালোবাসার খেলা চলছিল। দেখতে-দেখতে কেমন করে যেন বাগানের গাছপালা, ফুল, লতা–পাতার মতো আমিও আকণ্ঠ পান করছিলুম সেই বৃষ্টির জীবনীশক্তি। মন ভরে যাচ্ছিল। ঠিক হয়তো বোঝাতে পারব না, কিন্তু সেই অবিরাম জলধারার দিকে চেয়ে থেকে মনে হচ্ছিল আমার হয়তো উদ্ভিদের মতোই শাখা, কাণ্ড বা শিকড় গোছের কোনও গোপন প্রত্যঙ্গ আছে যা দিয়ে আমি বৃষ্টি থেকে সেই জীবনীশক্তি আহরণ করেছিলুম। ক্রমে রাত হয়ে এলে যখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না তখন ঘরে এসে এইমাত্র বসলুম ছোট বাতিটি জ্বালিয়ে তোমাকে চিঠি লিখব বলে।