সন্ধের পর নীচের রাস্তা দিয়ে তোটন যায়। টেরিলিনের প্যান্ট–শার্ট, চুল আঁচড়ানো, ঠোঁটে সিগারেট।
বীণা অন্ধকারে হেসে নেয়। তারপর গলা বাড়িয়ে ডাকে–তোটন। তোটন মুখ তুলে বলে–কী বউদি?
–কোথায় যাচ্ছ?
–অভিরামদার বাড়ি।
–রোজ যাও?
–যাই! দেখাশোনা করি, আমরা আত্মীয়রা কাছাকাছি আছি, আমরা না দেখলে কে দেখবে? বীণা হাসে-আত্মীয় আবার কী? তুমি তো অভিরামবাবুর পিসতুতো ভাইয়ের শালা, ওকে আত্মীয়তা বলে নাকি?
তোটন সিগারেটটা এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিল পিছনে। হঠাৎ মেয়েমানুষটার প্রতি একটা ঘেন্না বোধ করে সিগারেটটা বের করে একটা টান দিয়ে বলল –যা ভাবেন।
–ভাবাভাবির কী আছে ভাই? যার যেখানে ভালো লাগবে যাবে।
–তাই তো যাচ্ছি।
বীণা একটা শ্বাস ফেলে। তোটন চলে গেলে আবার প্রেতচক্ষু মেলে চেয়ে থাকে। তার চোখে ঝড়ের আগের হলুদ আলোটি কখনও বিস্ময় সৃষ্টি করেনি। সে অনুভব করেনি বৃষ্টির সৌন্দর্য। নীচের লোকালয়টির মানুষগুলির পচনশীল শরীরের মাংস কৃমির কথা সে শুধু ভাবে। তার ভারী আনন্দ হয়।
.
শানু ঘুম থেকে উঠে ডাকে–মাসি।
–যাই! রান্নাঘর থেকে সাড়া দেয় মনোরমা।
–আমাকে মশা কামড়াচ্ছে। চুলকে দাও। কেটলির জল ফুটে গেল, ভোটন এখনও এল না। আবার বাবুর জন্য জল চড়াতে হবে নাকি? ভারী বিরক্ত বোধ করে মনোরমা।
রান্নাঘরে হাতজোড়া বলে মনোরমার উঠতে দেরি হচ্ছিল। অনুপমা ও-ঘর থেকে ডাকল–শানু, মাসি কাজ করছে, আমার কাছে আয়, গা চুলকে দেব।
পরিষ্কার রাগের গলায় শানু বলল না, মাসি দেবে।
বোধহয় অভিমানে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল অনুপমা, তারপর হতাশ গলায় বলল –মনো, শানু আমার পর হয়ে যাচ্ছে।
কেটলিটা নামিয়ে ও-বেলার তরকারি গরম করতে বসিয়ে মনোরমা বলল –কী যা তা বলল , মাসি কি কখনও মা হয়!
অনুপমা ও-ঘর থেকে গুনগুন করে বলে–তোর ওপর আমার হিংসে নেই রে মনো, শানু বরাবরই আমার পর ছিল। বাপ বেঁচে থাকতে বাপকেই চিনত, মার কাছে ঘেঁষত না।
শানুকে কলতলায় নিয়ে গেল মনোরমা। মুখ-চোখ ধুইয়ে যখন জামা পরাচ্ছে তখন এল তোটন।
–চা হয়ে গেছে নাকি! বলে গোটা দুই হাঁচি দিল পরপর।
অনুপমা বিছানায় উঠে বসল, বলল –তোটন, আজ একটা চড়াইয়ের বাচ্চা আমার হাতে মরল। মনো, তোটনকে নিয়ে একবার যা না, কুসি বাচ্চাটা, একটু খুঁজে আন।
–এনে কী হবে? ঝঙ্কার দেয় মনোরমা!
–একটু মাটি চাপা দিয়ে রাখ উঠোনে! অন্ধকার হয়ে গেছে, টর্চটা নিয়ে যা।
–যাচ্ছি বাবা, একটু রোসো। মেয়েকে খাওয়াই, তরকারিগুলো গরম করে দিই, তোমার যে কী সব বাতিক!
–বাতিক না রে, আমার হাতেই মরল তো! কষ্ট হয়। কাকে বেড়ালে ছিঁড়ে খাবে, একটু মাটি চাপা দে। হরিনাম করে দিস, ওতে গতি হয়।
খুক করে একটু হাসল তোটন, বলল –চড়াইয়েরও গতি আছে নাকি! অল্পবয়সেই আপনি বড় বুড়ো হয়ে গেলেন বউদি!
–হলাম। বলে পাশ ফেরে অনুপমা।
মেঘ কেটে আকাশ এখন বড় পরিষ্কার। ঝলমলে নক্ষত্র আকাশময়। চাঁদও উঠবে একটু পরে। বাতাস ঠান্ডা, ভেজা। বাইরের ফিকে অন্ধকারের দিকে অভিমানভরে চেয়ে শুয়ে আছে। অনুপমা। শিশুর মতো শোওয়ার ভঙ্গি।
সেদিকে চেয়ে বড় কষ্ট হল মনোরমার। ভগবান ওর সব কেড়ে নিলেন। বর্ষার পর গাছে। যেমন পাতা আসে তেমনি ওর সুখ সদ্য ফুটতে শুরু করছিল। তখনই–
তোটন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল –সর্দি লেগে গেল।
মুখ ফিরিয়ে গিন্নির মতো মনোরমা বলে বৃষ্টিতে ভেজা কেন?
তোটন বলল –এমনিই। নতুন বর্ষা, প্রথম ঝড় দেখে ভাবলাম, একটু ঝড় খাই। ঠান্ডা লেগে গেল, ফ্যারিংসের দোষও আছে। জ্বর না এসে যায়!
শরীর যতটা খারাপ তার চেয়ে বেশি ভান করা হচ্ছে। মনোরমা বোঝে। পুরুষদের কায়দা কৌশল সবই পুরোনো এবং বোকার মতো, সেই কারণেই ভালো লাগে মনোরমার।
শানু ডাকে–মাসি!
–উমম!
শানু রাগের গলায় বলে আমাকে আবার মশা কামড়াচ্ছে।
–এ ঘরে এসো।
–না। তুমি আমার কাছে এসো।
অনুপমার ঘর থেকে ওই ঘরে চলে যাওয়ার এই একমাত্র অজুহাত এবং সুযোগ। মনোরমা শানুর কাছে উঠে গেল। শানু বিছানায় ছবির বই খুলে বসেছে, কোলে পুতুল। পুতুলকে ফ্রক দিয়ে ঢেকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ওর পাশে বসে পিঠে হাত বোলাতে-বোলাতে উৎকর্ণ হয়ে থাকে মনোরমা। তোটন আসবে। অনুপমার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে ঠিক উঠে আসবে। রোজই আসে।
তোটন বলল –যাই।
–এসো।
তোটন ও-ঘরে গেল। অনুপমা চিৎ হয়ে শুয়ে ওপরের দিকে চেয়ে দেখছিল। মা–পাখিটা ফিরে এসেছে। ভিজেছে খুব, থরথর করে কাঁপছে। ভেন্টিলেটর থেকে বাসাটা বাচ্চাসুদ্ধ খসে গেছে। শূন্য জায়গাটায় বসে পাখিটা ডাকছে। ভাষাটা বোঝা যায় না। কিন্তু অনুপমা বুঝতে পারে। বুঝতে কষ্ট হয় না।
তোটন আর মনোরমা পাখির বাচ্চাটাকে খুঁজতে গেল না। ভুলে গেছে। ও-ঘরে বসে কথা বলছে দুজন। হাসছে। অনুপমা এখন আর হাসে না! হাসবে না বহুদিন। পৃথিবীর হলুদ রংটা মুছে গেছে। বাতাস এখন উলটোবাগে বয়, যত রাজ্যের পুরোনো কথার ধুলোবালি ছড়িয়ে যায় ঘরময়। বড্ড মনে পড়ে আজকাল।
ভেজা চড়াইটা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ডাকল ‘চিড়িক’ করে। অনুপমা চেয়ে থাকে। হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় ভালো দেখা যায় না। অনুভব করা যায়। পাখিটা কাঁপছে। ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ঝড়ের রংটা নিঃশেষে মুছে গেছে। রং মুছে গেলেই পৃথিবীটা কেমন গভীর হয়ে যায়।
হাওয়া বদলের চিঠি
বুধুয়াকে তোমার মনে আছে কিনা জানি না। মনে না থাকার কথা নয়, বছরখানেক আগে সে আমাদের কলকাতার বাসায় চাকরি করত। গোলগাল গাল, গোপাল গোপাল চেহারা, মাত্র দু মাস চাকরি করেছিল আমাদের বাসায়, শেষে, মায়ের জন্য মন কেমন করছে বলে কেঁদে–কেটে চলে গেল। যে দু-মাস ছিল তাইতেই বড় ভালো লেগেছিল বুধুয়াকে, তুমি ওকে অকর্মা মনে করতে বটে, কিন্তু আমি ওকে পুষ্যি নিতেও রাজি ছিলুম। তুমি ভুলে গেছ কি? কাল হঠাৎ সেই বুধুয়া এসে হাজির। এখানে দেওঘরের কাছাকাছিই যে ওর বাড়ি তা আমার মনেও ছিল না, হঠাৎ দেখে চিনতেও পারিনি, এখন ওর বাড়ের বয়স–তাই মাথায় একটু লম্বা হয়েছে, একটু রোগাও, শুধু মুখের মিষ্টি হাসিটুকু এখনও কি করে যেন শুদ্ধ রেখেছে। আমি যে এসেছি তা জানত না, একদিন বিকেলে যখন বেড়াচ্ছিলুম তখন নাকি দেখেছে আমাকে। তখন ভয়ে এসে কথা বলেনি; খোঁজখবর নিয়ে তবে বাসায় এসেছে। বুদ্ধি দ্যাখো, একেবারে শুধুহাতে আসেনি, বৈদ্যনাথের পূজা দিয়ে প্রসাদি প্যাঁড়া এনেছে কিছু আর শালপাতার ঠোঙায় এনেছে ওর মায়ের হাতের তৈরি করা করমচার আচার। জিগ্যেস করলুম, প্যাঁড়া আনলি যদি তবে প্রসাদি আনলি কেন? অনেকক্ষণ লাজুক মুখে হেসে মাথা নীচু করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায় যে, এমনি আনলে যদি আমি না নিতে চাই সেই ভয়ে প্রসাদ করে এনেছে–প্রসাদ তো আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। কেমন মাথা খেলিয়েছে দেখেছ? শমীক আর খুকু কেমন আছে জানতে চাইল। যখন জিগ্যেস করল দেওঘরে কেন এসেছি, তখন একটু মুশকিলে পড়লুমকী জবাব দিই! তখন ও নিজেই বলল , যে আমার চাকর হরিয়ার কাছে নাকি শুনেছে যে আমার অসুখ। আমি ওকে বোঝালুম যে সে তেমন কিছু নয়, একদিন অফিস যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলুম রাস্তায়, তাই দেখেশুনে ডাক্তার বলেছে একটু ঘুরে আসতে, ও চুপ করে শুনল তারপর ব্যথিত মুখে বসে রইল। তখন আমিই ওকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানা কথা জিগ্যেস করলুম। সিনেমা হলের কাছে পান সিগারেটের দোকান দিয়েছে দোকান ভালো চলে, আর শহরের একটু দূরেই ওর গ্রাম–সেখানে খেতি–গৃহস্থি দেখাশোনা করে ওর মা আর ভাই। খুব লাজুক মুখে জানাল যে, কলকাতায় আমাদের বাসায় থাকবার সময় সে বলেছিল বিয়ে করেনি সেটা মিথ্যে কথা। বিয়ে করেছে দশ বছর বয়সে, এখন পনেরো কিন্তু এখনও গাওনা হয়নি। আরও নানা কথা বলল , বারান্দায় মেঝের ওপর আমার পায়ের কাছটিতে বসে, আমি ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলুম। অধিকাংশই ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা, বারবার বলল বুড়ো হলে ও কোনও আশ্রমটাশ্রমে গিয়ে থাকবে, সংসারে নাকি ওর খুব একটা স্পৃহা নেই। ওর চেহারার মধ্যে এমন একটা সরল সত্যনিষ্ঠার ছাপ আছে যে কথাগুলোকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তুমি সঙ্গে আসোনি কেন সেকথাও জিগ্যেস করল, আরও বলল , আমার কোনও কাজকর্ম করে দেওয়ার থাকলে ও করে দেবে। এ সময়ে বাজার করে হরিয়া ফিরে এলে, তখন আমাকে ছেড়ে দুজনে দেশওয়ালি ভাষায় নিজেদের মধ্যে খানিক গল্প করল। যাওয়ার সময় বলে গেল যে ওর গ্রামে একজন গুণী লোক আছে যে ঝাড়ফুঁক করে, টোটকা ওষুধ দেয়। অনেকের রোগ সে নাকি সারিয়েছে। যদি আমার আপত্তি না থাকে তবে সে একবার সেই গুণীকে ডেকে এনে দেখাবে।