কেউ শুনল না, শুকনো পাতা উড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটা ফাটছে চড়বড় করে টিনের চালে–তার শব্দে অনুপমার গলা ডুবে গেল। জানলার জালের নীচে ছোট্ট ফোকর, সেই ফোকরটা দিয়ে পাখির ছানাটা গলে বাইরে গিয়ে পড়েছে। বাইরে ঝড়।
অনুপমা ঝড়ের বাতাস উপেক্ষা করে বিছানায় কষ্টে হাঁটু গেড়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছিল। জানালার ধারে নর্দমা, নর্দমার পাশে-পাশে ডুমুরের গাছ কচুর ঝোঁপ, ভাঙের জঙ্গল। কোথায় গিয়ে পাখিটা পড়ল!
বাইরে সেই অদ্ভুত আলোটি, হলুদ। পাখিটা খুঁজতে-খুঁজতে অনুপমা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আলোটা তার গায়ে কেমন আভা ছড়িয়েছে! ইচ্ছে করল এই আলোতে হাত–আয়নায় একবার নিজের মুখটা দেখে।
অনুপমার ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করেছে মনোরমা। এখন বিছানাটা ঝাড়ছিল।
অনুপমা নিস্তেজ গলায় জিগ্যেস করে–শানু উঠেছে?
–না! ঠান্ডা বাতাস পেয়ে ঘুমোচ্ছে। আরও একটু ঘুমোবে আজ।
অনুপমার একবার বলতে ইচ্ছে হল–শানু উঠলে ওকে সবজির ঝোলটা খাওয়াস মনে করে। তারপর ভাবল, মনোই তো খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, সব করে। বলার দরকার কী? গত দু-মাস ধরে মননাই তো সব করছে! শানু অনুপমার কাছে বড় একটা আসে না আজকাল।
–একটা পাখির বাসা বিছানায় পড়েছিল, একটা চড়াইছানা শুদ্ধ। চড়াইছানাটাকে ধরতে গিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি। বৃষ্টিটা থামলে একটু ঘরের পেছনে গিয়ে দেখিস তো?
–ফেলে দিলে? কাকগুলো ঠুকরে কিছু রাখবে নাকি? নইলে বেড়াল মুখে করে নিয়ে যাবে।
–ধরতে গিয়েছিলাম, আঙুলটা সরু পায়ে আঁকড়ে ধরল এমন! মাগো বলে চমকে হাত ঝাড়লাম, ছিটকে বাইরে পড়ে গেল। বাঁচবে না ঠিকই, তবু দেখিস তো একটু। কুসি ছানাটা, মা পাখিটা রাতে এসে কাঁদবে হয়তো।
মনোরমা বলে–এ পাশটা বৃষ্টির ছাঁটে একটু ভিজে গেছে দিদি।
–ভিজুকগে। বড় বিছানা, আমি তো একটা পাশে পড়ে থাকি।
–ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, তুমি একটা কিছু গায়ে দিয়ে শোও। একটা কাঁথা বের করে দেব?
–থাকগে, একটু জুড়োই কিছুক্ষণ। পিঠটা ঘামাচিতে ভরে গেছে। চা করবি নাকি? করলে একটু দিস।
–এক্ষুনি করব? চা খাওয়ার একজন লোক তো বিকেলে আসেই, সে এলে একেবারে করতাম।
–তোটন কি আজ আসবে? যা বৃষ্টি!
পালকের ঝাড়নে খাটের বা জ্বর মিহি ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মনোরমা মুখ লুকিয়ে হাসে। আসবে না আবার! না এসে পারে নাকি?
–তোর জামাইবাবুর ছবিটা মুছিস। মালাটা শুকিয়ে গেছে, ফেলে দিস।
ছবিটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনোরমার বুকটা কেমন করে। অভিরামদা তেমন সুন্দর ছিল না। মোটাসোটার ওপরে চেহারা, প্রকাণ্ড গোঁফ ছিল, মুখখানা সাধারণ। কিন্তু এসবে কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে কোটি–কোটি পুরুষ আছে, তবু তার মধ্যে ওই একজনই ছিল অনুপমার মানুষ। আলাদা মানুষ, একার মানুষ, নিজের মানুষ। মাসদুই আগে অভিরামদা মারা গেছে, অনুপমা তারপর থেকে আজও বিছানা ছাড়েনি। সেই কালিকাপুর থেকে মনোরমা এসে আছে টানা দু মাস। শানুকে রাখে, অনুপমার দেখাশুনা করে। অভিরামদা বাড়িটা করে না গেলে দিদি আজ অবশ্যই কালিকাপুরে বাপের বাড়ির গলগ্রহ হয়ে থাকত। অল্পবয়সেই বাড়ি করেছিল অভিরামদা। তোটন পারবে কি? ছাই পারবে। এখনও চাকরিই পেল না।
বৃষ্টির সাদা চিক–এ ঢেকে গেল কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড়। মাঠে দুধের মতো সাদা–সাদা ফেনা তুলছে বৃষ্টি। বাতাসে বলটা ঘুরে যায় এদিক-সেদিক, জলের মধ্যে থপ করে পড়ে আটকে যায়, আবছা হয়ে গেল মাঠ। খেলোয়াড়রা দৌড়ে মাঠ ছেড়ে চলে আসতে থাকে। সবার আগে তোটন, তার বুকে ধরা বল।
চারধারেই পুকুর, মাঠ, ঘাট, আর শহরতলির নতুন না-হওয়া বাড়ির ভিত। তারা কেউ একসঙ্গে ছোটে না। দু-চারজন একটা বাড়ির নীচের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাদবাকি সবাই শিবাজীর চায়ের দোকানে।
দাঁড়ায় না একমাত্র তোটন, বুকের বলটা শিবাজীর চায়ের দোকানের ভিতরে ভিড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলে–সন্ধের পর দেখা হবে গণেশ।
গণেশ পিছন থেকে চেঁচায়–কোথায় যাচ্ছিস?
তোটন জবাব দেয় না। তার চারধারে ঝড় আর ঝড়। এক পাল পাগল হরিণের মতো বৃষ্টি ছুটছে। জলপ্রপাতের মতো পড়ছে। তার ভিতরে দেখা যায়, মজা পুকুরের কচুরিপানার পাতাগুলো উলটে দিচ্ছে বাতাস। তার পায়ে বুট, গায়ে কলারওয়ালা সাদা গেঞ্জি, পরনে খাটো প্যান্ট। ঝড়ের প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো নিজেকে বোধ করে সে। কোথায় যাবে? কোথাও না, তোটন দৌড়োবে একা, অনেক দূর।
নীল আগুন ঝলসে ওঠে অকাশে। গুড়গুড় করে মাটি কাঁপে। তোটন হা–হা করে হাসে। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োয়।
আজ স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে একটা রিগ্রেট লেটার এসেছে। চাকরিটা তার হল না। না হোক। তোটন এখন যে ঘাসপাতা, যে মাটির ওপর দিয়ে দৌড়োচ্ছ, চারধারে যে বৃষ্টির ঝরোকা,
উদ্ভিদের স্বেদগন্ধ, যে শব্দ ও স্পর্শ–এসবের মধ্যে ঠিকই থেকে যাবে তোটন। থাকবে আনন্দ। সে কখনও কাউকে কষ্ট দেবে না। কী ভালো এই ঝড় এবং একাকী সে! অনেকক্ষণ দৌড়োবে তোটন! একা একা।
.
সন্ধেবেলায় বীণা তার দোতলার অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রোজ। মোটা কালো বীণার স্বামী আশু পোদ্দার পয়সা করেছে। দু-দুটো দোকান। কিন্তু এক দুঃখ, তাদের ছেলেপুলে নেই। স্বামীর তেমন টান নেই বীণার দিকে। রাত করে ফেরে, কাকভোরে আবার বেরোয়। সারাদিন বীণা একা। প্রেতচক্ষু মেলে সে দোতলা থেকে নীচের লোকালয়টির দিকে লক্ষ রাখে। পাড়ার সব কুমারীর খবর রাখে সে, সব বউয়ের। কোন কুমারীর পেটে জ্বণ এল, কোন বউকে স্বামী নেয় না, কে পরপুরুষের সঙ্গ করে, কার বা আছে বাঁধা মেয়েছেলে–কাকের মতো এইসব নোংরা খোঁটে সে, তারপর এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছড়ায়।