–না-না, থাক। গিরিজা ভয় খেয়ে বলেন। কানাওয়ালাটা আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। ছেলে তফাত হলেই ধরবে। তিনি অস্ফুট গলায় বলেন–রাম রাম।
আবু বিরক্ত হয়ে বলে–কালী-কালী বলল । কালী নাম আর হকি। দেড়শো-দুশো বছর হেসে-খেলে।
বাড়ি এখনও দূর আছে। খিদেটা এমন কামড়ে বেড়াচ্ছে পেটের মধ্যে। মোচার ঘণ্ট আর ডালসেদ্ধ নিয়ে এক ভুর ভাত খাবেন আজ গিরিজা। ব্যাটারা বলে বুড়ো বয়েসে কম খেতে হয়। ইঃ! কম খাবে!
আবু হাত বাড়িয়ে একটা হস্তুকি দিয়ে বলে–খাও বাবা। সাংঘাতিক জিনিস। খিদেটা বড় কষ্ট দিচ্ছে। হকিটা আস্ত মুখে ফেলে মাড়ি দিয়ে চিবোতে থাকেন গিরিজা। সাঁৎ–সাঁৎ করে হত্ৰুকিটা পিছলে যাচ্ছে মাড়ি থেকে। রস বেরোচ্ছে না তবু চেষ্টা করতে থাকেন গিরিজা। চেষ্টাই তো জীবন।
হলুদ আলোটি
অদ্ভুত এক আলোর ভিতরে ঘুম ভাঙে মনোরমার। রোজকার আলো নয়। পাকা যজ্ঞিডুমুর ভাঙলে যেমন রং তেমন এক আলো। মনোরমার পায়ের দিককার জানালার ধারে ডুমুর ফল রোজ এসে ঠোঁটে ভাঙে বুলবুলি। সেই রংটাই এখন পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেছে এই বৈশাখের বিকেলে।
শানুর থুতনিতে ঘাম, নাকের নীচে ঘাম, বুকে গলায় মুক্তোফল ফুটে আছে ঘামের। বড্ড ঘামে মেয়েটা। কোমরের জাঙিয়ার ইলাস্টিক আঁট হয়ে কোমরে বসেছে। ঘুমের আগে বাতাসা খেয়েছিল, বিছানায় সেই বাতাসার গুঁড়ো, আর লাল পিপড়ে। কামড়েছে সারাক্ষণ, তবু নিপাট ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। মনোরমা শানুর জাঙিয়া খুলে দেয়, বিছানাটা হাত দিয়ে ঝাড়ে, তারপর হঠাৎ নিঃঝুম হয়ে আলোর দিকে চেয়ে থাকে। এ কি পৃথিবী? এ কি পৃথিবী নয়?
পৃথিবীর কি–ই বা সে জানে। একটা শ্বাস ফেলে। কিছু না। তবু মনে হয় তার ঘুম ভেঙেছে এক স্বপ্নের ভিতরে। মাঝে-মাঝে গাছপালা, মাটি, আকাশ পালটে যায়। যজ্ঞিডুমুরের গাছে একটা বুলবুলি ডুমুর ভাঙছে। পাখির গায়ের রোঁয়া উলটে যাচ্ছে হাওয়ায়! মনোরমা ঝুঁকে দেখল, আকাশে ঝড়ের মেঘ। গুমোট ভেঙে দমকা হাওয়ায় ধুলোবালি আর পুকুরের আঁশটে গন্ধ উড়ে এল।
জানালার জালের নীচে একটুখানি ফোকর দিয়ে সাবধানে হাত বাড়িয়ে মনোরমা জানালা বন্ধ করে। উঠে বাইরে আসে। হাওয়ায় তারের ওপর শুকোতে দেওয়া শাড়ি ঝুলে উঠোনে লুটোচ্ছে, শানুর ফ্রক উড়ে গেছে বাগানে, কয়লার স্তূপের ওপর পড়ে আছে ব্লাউজ। সেগুলো কুড়িয়ে নেয় মনোরমা, আর তখনও তার নিবিড় এলোচুলে ঝড়ের বাতাস এসে লাগে, ছুটে আসে বৃষ্টির গন্ধ, তামাটে মেঘে থেকে অদ্ভুত আলোটি ধীরে-ধীরে বহুদূর পর্যন্ত রঙিন করে দিচ্ছে। এই হচ্ছে ঝড়ের রং। এখুনি রেলগাড়ির মতো ঝড় এসে যাবে। তবু দু-দণ্ড মনোরমা দাঁড়ায়। কত অচেনা জায়গা ছুঁয়ে আসে ঝড়, কেমন পুরুষ স্পর্শ তার। মনোরমা দু-দণ্ড দাঁড়ায়, তার কপালের ওপর বড় একটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পাখির ডিমের মতো চড়াৎ করে ফাটে। অমনি দৌড়ে ঘরে আসে মনোরমা, মনে পড়ে–ওই যাঃ অনুপমার ঘরের জানলা তো সে বন্ধ করেনি! কত ধুলো ঢুকে গেছে। দিদি চেঁচাবে ঠিক।
.
অনুপমার ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ, সমস্ত বিছানাময় বালি কিরকির করছে, দাঁতে ধুলো, চুলে ধুলো। বিছানার চাদর উলটে গেছে হাওয়ায়। জানালার পাল্লাগুলো মড়মড় করছে, একটা পাল্লা ব্যাং খুলে ঠাস করে শব্দ করল। খড়কুটো উড়ে পড়েছিল কিছু, ভেন্টিলেটারে পাখির বাসা দমকা হাওয়ায় খসে পড়ল বিছানায়! চমকে উঠে মনোরমার নাম ধরে চেঁচাতে যাচ্ছিল সে, ঠিক সে সময়ে বাইরের রংটা চোখে পড়ল। শালিকের পায়ের মতো হলুদ এ কেমন রং? হলুদ রংটাই কেমন শিরশিরানি তুলে দেয় শরীরে। মনে পড়ে হুলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ, মাঘের দুপুরে উঠোনে পিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে শীতল জলে সেই রোমাঞ্চকর স্নান। হলুদ সেই রংটা কে ঢেলে দিয়েছে চারধারে এখন! পাখির বাসাটা আপনিই গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেয়। আজকাল বড্ড মনে পড়ে। বাতাস বয় উলটোবাগে, ঠিক সেইসব পুরোনো কথা ধুলো বালির মতো উড়িয়ে আনে, ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে যায়! সে এক বাতাস অনুপমার বুকের ভিতরে দমকা মেরে ঘোরে, ঝড় ওঠে। আজকাল বড্ড মনে পড়ে।
পাশ ফিরতে অনুপমা কুসি ছানাটাকে দেখতে পেল। আহা রে, কতটুকু চড়াইয়ের ছানা। একটা, মুখে বোল ফোটেনি তবু বারবার হাঁ করছে। সদ্য জন্মেছে বলে গায়ের পাতলা চামড়ায়। এখনও রোঁয়া ওঠেনি, রাঙা শরীর কাত করে পড়ে আছে বিছানায়, অনুপমার পায়ের পাতার পাশেই। আর একটু হলে চাপা পড়ত।
অনুপমার উঠে বসতে বড় কষ্ট হয়। বুক ধড়ফড় করে। পাখির ছানাটার দিকে হাত বাড়ায়। ঠিকই, ধরতে সাহস হয় না। কতটুকু ওর শরীর। ডিমসুতোর গুলির মতো একটুখানি। এমন পলকা জীব ধরতে ভয় করে। যদি হাতের চাপে মারা যায়!
বৈশাখী ঝড়ের একটা ঝাঁপটা এসে লাগে বড় নারকেল গাছে। ডগাশুদ্ধ বিশাল একটা শুকনো নারকেল পাতা টিনের চালের ওপর হুড়মুড় করে খসে পড়ে। অনুপমা আজকাল আর চমকায় না।
চড়াইয়ের ছানাটা হাঁ করে আছে। তেষ্টা পেয়েছে নাকি? তোর মা মুখপুড়ি কোথায় রে? আহা কাঁপছে দ্যাখো থিরথির করে। অনুপমা সাবধানে হাত বাড়িয়ে চড়াই ছানাটাকে তুলে নেয়!
সরু কাঠির মতো দু-খানা পা, ছুঁচের মতো সরু নখ তাই দিয়ে ছানাটা অনুপমার একটা আঙুল আঁকড়ে ধরল। শিউরে উঠে বে–খেয়ালে হাত ঝেড়ে ছানাটাকে ফেলে দিল অনুপমা, চেঁচিয়ে ডাকল–মনো, শিগগির আয়।