আর-একটা ঢিল গদাম করে পড়ল কাছে-পিঠেই, কোনও গুদামের চালে। ঢিল নয়, এখন আধলা কিংবা থান ইট ছুড়ছে। একটা-দুটো চৌকিদার এখানে ঘোরাফেরা করে রোজ। তাদেরও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্না রাতে বোধহয় আহ্লাদ হয়েছে খুব ব্যাটাদের, ছিলিমে দম দিয়ে, নয়তো সিদ্ধি চড়িয়ে কি দিশির চাপান দিয়ে পড়ে আছে। সরকারি গোয়ালে আর কী ধোঁয়া দেবে!
আছেন শুধু রামচন্দ্র। হৃদিস্থিতেন। কিন্তু তবু বুকটা বড় কাঁপছে। খিদেটা পেটের মধ্যে গেঁকি কুকুরের মতো ঘেউ-ঘেউ করে ধমকাচ্ছে তাঁকে।
ছাতাটা হাতে থাকলে একটু সাহস পেতেন। ভূতপ্রেত যাই হোক, ছাতা লাঠি কিছু হাতে থাকলে যেন একটু জোর–বল পাওয়া যায়। ওরা অবশ্য ছাতা কাল ফেরত দেবে। তবু
তাঁর ছেলে আবুটা মানুষ নয়। বউ বিপদ বুঝে ছেলেপুলে নিয়ে পিটটান দিয়েছে। সারাদিন মাথামুণ্ডু করে বেড়ায়। যৌবন বয়সে মিলিটারিতে গিয়েছিল মণিপুর ফ্রন্টে। সেখান থেকে ফিরে ওকে কালীতে পেল। ঘুমের মধ্যে ‘বুবি ট্রাপ বুবি ট্রীপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠত। তারপর নানা ঘাটের জল খেয়ে এখন পেশকার। ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছেন পেশকারি সোনার চাকরি। পেশকারের মা বেনারসি পরে পায়খানায় যায়, তেল দিয়ে আঁচায়। কোথায় কী? আবু মাস মাইনের অর্ধেক তার খাণ্ডার বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে আসে। সেই বউ মাইনের তারিখে কোর্টের দরজায় মোতায়েন থাকে। উপরিও পায় না কিংবা নেয় না। অপদার্থ ভ্যাগাবন্ড।
ভাববেন, তার জো কি! ভূতটার আজ রস উছলে পড়ছে। দমাদম ঢিল মারছে ইদিক-সিদিক। ছাতাটা থাকলে কতকটা রক্ষে হত। কখন কোনটা মাথায় এসে পড়ে! রাম-রাম। যৌবন বয়সে ভূতকে মানেন কী বলে আজ সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দুটো কান ধরে বললেন–ঘাট হয়েছে বাবা। আর অমন করব না। তোমাদের গড় করি। ভালো করে নিজের কান মললেন, কাঁদলেনও একটু। বলেন রাস্তাটা চিনিয়ে দাও বাবাসকল, জ্যোৎস্না একটু ঘুরিয়ে ফেল, চোখ ধাঁধিয়ে যায় বাবা। খিদের টানে শরীর হজম হয়ে যাচ্ছে। ওই বুঝি চৌকিদারের হুঁশ হল এতক্ষণে!
–কোন হ্যায় রে? বলে অশ্রাব্য খিস্তি দিল একটা। তারপর লাঠি ঠুকবার আওয়াজ। কে যেন চেঁচিয়ে বলল –উও ভাগ রহা। এ রামরিখ ভাই, পাকড়ো–
খুব চেল্লাচেল্লি আর দৌড়োদৌড়ি লেগে গেল। আশপাশেই হচ্ছে। গুদামঘরগুলোর জন্য দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খুব একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠল। ভারী-ভারী জুতোর শব্দ হচ্ছে রাস্তায়। ধুপধাপ মাটি চমকাচ্ছে।
একটু নিশ্চিন্ত হন গিরিজা। লোকজন দেখলে ভূত তফাত যায়।
কিন্তু রাস্তা বেভুল–করা কানাওয়ালা যে এখনও ছাড়েনি। কোন দিকটায় যাবেন ঠিক ঠাহর পাচ্ছেন না। তবু গুটিগুটি রওনা দিলেন। দেখা যাক।
বাপ রে! কালো মতন কি একটা ধেয়ে এল! জ্যোৎস্নার মধ্যে একটা করাল চেহারা। আকাশের দিকে হাত তোলা, চুল উড়ছে, আর হাহা অট্টহাসি।
কেঁদে কঁকিয়ে উঠে বসে পড়েন গিরিজা, অস্ফুট গলায় বলতে থাকেন–রাম রাম রাম রাম—
ভূতটা থমকে দাঁড়ায়। বলে–কে রে, রাম নাম করিস?
গিরিজা সভয়ে বলেন–বুড়োমানুষ বাবা, মাপ করে দাও।
–কালীর নাম কর, কালীর নাম কর। কালীর নামে জগৎ উদ্ধার…আরে বাবা নাকি?
গিরিজা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ান। ছাতাটা ফেলে এসেছেন বলে খুব দুঃখ হচ্ছে। হাতে থাকলে দামড়াটাকে ঘাকতক দিতেন।
ভয়ংকর রেগে গিয়ে বললেন–তুই কোত্থেকে–অ্যাঁ?
আবু ঝপ করে বাপের হাতটা চেপে ধরে বলে–দৌড়োও। চৌকিদাররা টের পেয়ে গেছে।
–কী টের পেয়েছে।
–পরে বলছি। দৌড়োতে না পারো জোর কদমে হাঁটো। নাহক এসে হামলা করবে।
–কিছু করেছিস নাকি?
বাপের হাতে ধরে গুদাম ঘরের ছায়ায়-ছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে জোর হাঁটে আবু। বাবাকে প্রায় হিচহেড় নিয়ে যায়। হাসতে-হাসতে বলে–আরে না। কয়েকটা ঢিল ছুড়ছিলাম।
গিরিজা অবাক হয়ে বলেন–ঢিল ছুঁড়েছিলি? আজ কি নষ্টচন্দ্র?
–আরে না। বলে খুব হাসে আবু।
–তবে কি শেয়াল?
–আরে না। শালারা হকির গুণ মানতে চায় না। গত সাতদিন ধরে খেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি হত্ত্বকির মতো জিনিস হয় না। যৌবন ফিরে আসে। দেখবে? গুদাম পার হয়ে মাঠের মধ্যেকার পথ পেয়ে গেছে তারা। আবু একটা মস্ত ঢেলা কোত্থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আচমকা চাঁদের দিকে ছুড়ল। সেটা খানিক উঠেই ধপ করে পড়ল।
–দেখলে? আবু জিগ্যেস করে।
–হুঁ।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ। খুব ক্ষমতা বেড়ে যায়। চৌকিদার শালারা ধরতে পারত নাকি আমাকে? এমন দৌড় দিয়েছিলাম না? কী যে দম পাই এখন বাবা, মনে হয় এক নাগাড়ে দশ-বিশ ক্রোশ। দৌড়াতে পারি। হকিতে সব হয়।
গিরিজা নিশ্চিন্তে হাঁটছেন। পাগল হোক, ছাগল হোক, তবু তো ছেলে! ঠিক সময়টায় গিয়ে ওই ভূতুড়ে গোলকধাঁধা থেকে হাত ধরে টেনে এনেছে। ভগবান এখনও আছেন। রাম নামের জোর করে বাবা! ক’বার করতে–না-করতেই বাতাস ফুঁড়ে ছেলে বেরিয়ে এসে কুড়িয়ে নিল। নইলে বেঘোরে মারা পড়তেন নির্ঘাত।
আবু –ঝলে বাবা!
–হুঁ।
–যুদ্ধের সময়ে মণিপুর ফ্রন্টে আমাদের একরকম বড়ি দিত। খেলে খিদে নষ্ট হয়ে যেত, শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে চাঙা হয়ে উঠত। চারদিকে বুবি ট্রাপ, বুবি মানে জানো তো। বুবি মানে বোমা। মাটিতে মাইন, ওপরে বোমা। সে-সময়ে একটু ঝিমুনি এল কি খিদেয় অস্থির হলে তো গেলে। ওই বড়ি খেলে সব কেটে যেত। মাইলের-পর-মাইল জঙ্গল ভেঙে বোঝা টেনে হাঁটতাম। বুঝলে বাবা, বহুকাল বাদে হতুকিতে আবার সেরকম জোর পাচ্ছি। দেখবে? একটু দৌড়ে দেখাব?