সন্ধেবেলা সে মানিকরামের ডাক্তারখানায় উঠে বসে পড়ল। ডাক্তারখানায় রুগি–টুগি আসে। মানিকরামের ঢের পৈতৃক পয়সা আছে, আর ব্রিজ খেলার নেশা। পসার নেই। নিতান্ত দায়ে
পড়লে কেউ তাকে ডাকে না, বলে–ও তো তাস খেলতে-খেলতে ডাক্তারি ভুলে গেছে। তবু ডাক্তারখানা আছে নামকোবাস্তে। সন্ধের পর সেখানে ব্রিজের আড্ডা বসে, কিছু উটকো লোক সময় কাটাতে আসে, গল্পগাছা হয়। আবু ডাক্তারখানায় ঢুকতেই কিছু লোক খবরের কাগজের পাতা ভাগ করে ডুব দিল, একজন অন্যধারে উঠে গেল। চোরের দায়ে ধরা পড়ল বেকার কম্পাউন্ডার সাধন। সে টোকা দিয়ে মশা মেরে টেবিলের ওপর জড়ো করছিল। রোজ সেঞ্চুরি করে। আজও তিরাশিটা হয়েছে এ পর্যন্ত। আর সতেরোটা বাকি। টেবিলের ওপর মরা মশার একটা ছোট স্তূপ তৈরি হয়েছে। চুরাশি নম্বর মশাটা পান করে কানের কাছ থেকে উড়ে এসে থুতনিতে ধাক্কা খেয়ে বসি-বসি করছে। সাধন খুব সাবধানে অনড় হয়ে লক্ষ রাখছিল। এমন সময়ে আবু উঠে এসে ঝপ করে বসেই বলতে শুরু করল হুতুকির যা কাণ্ড দেখলাম সাত দিনে, বলার নয়।
মশাটা বসল না। উড়ে অন্যধারে চলে গেল। বিরক্ত হয়ে সাধন বলে–বেশি খেও না আবুদা। আবু অবাক হয়ে বলে–বেশি খাব না?
–না। পরে বিপদে পড়বে।
আবু রেগে গিয়ে বলে–হতুকির তুই জানিসটা কী শুনি! মুনিঋষিরা একটা করে পাকা হকি খেয়ে কতকাল বাঁচত জানিস?
–মুনিঋষির কথা বাদ নাও। তারা না হয় একটা করে খেত, তুমি কিন্তু দশ-বারোটা করে চালাচ্ছ। শেষে বিপদে পড়ে যাবে।
–যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলবি না। বিরক্ত হয়ে আবু বলে।
–দাসীর কথা বাসি হলে কাজে লাগবে। সাধন চুরাশি নম্বর মশাটিকে গোঁড়ালির হাড়ের ওপর খতম করে টেবিলের ওপর রাখল। আর যোলোটা। আবুর দিকে চেয়ে বলল –বেশি হকি খেলে শুক্রতারল্য হয়।
হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হেসে ওঠে আবু। মূর্খ বলে কী? তা ছাড়া হরীতকীতে ওরকম কিছু হতে পারে, এ ভাবাই যায় না।
আবু বলে–বুঝলে বাবা, হরীতকী হল অমৃত। এ রেগুলার খেলে একশো-দুশো বছর বেঁচে থাকাটা কোনও কথাই নয়। বাঁচতে-বাঁচতে ঘেন্না ধরে যাবে। তখন মরার জন্য আনচান করে উঠবে, কিন্তু মরা কি সহজ?
ডাক্তারখানা থেকে নেমে রাস্তায় সে মুদি খগেনকে পেয়ে গেল। খগেন তার রাখা মেয়েমানুষের বাড়ি যাচ্ছে। অনেকটা পথ তাকে সঙ্গ পেয়ে ভারী আহ্লাদ আবুর। হরীতকীর যাবতীয় গুণের কথা কি বলে শেষ করা যায়! এত সস্তা, হাতের কাছের জিনিস লোকে তবু গ্রাহ্য করে না। মূর্খ সাধনচন্দ্র কী যেসব বললে, হ্যাঃ! এক হপ্তা খেয়ে আবুর নিজের পুরোনো অম্বলের অসুখ নেই। অম্বলের চাকা পেটময় বেড়াত, গলে তরল হয়ে গেছে। চোখে ছানির ভাব ছিল, কেটে গেছে। বাহান্ন বছর বয়সে এখন হঠাৎ শক্তির জোয়ার এসেছে গতরে।
হঠাৎ আবু খগেনকে বলল –দাঁড়াও।
খগেন দাঁড়ায়। রাস্তার পাশে প্রচুর বড়-বড় চাঁই পাথর পড়ে আছে, রাস্তা মেরামতের কাজে লাগবে। তারই একটা মাঝারি চাঁই তুলে নিয়ে আবু রাস্তার পাশে মাঠটায় যতদূর সম্ভব ছুঁড়ে দিলে, বলল –দেখলে? গত সাতদিনে কতটা ক্ষমতা বেড়েছে!
খগেন শ্বাস ফেলে বলে–দেখছি।
তার দেরি হয়ে যাচ্ছিল। মাঠের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করতে নেমে গেল খগেন। একা-একা কালীর গান করতে-করতে আবু সরকারি গুদামের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে।
৩.
এই বয়সে খিদেটা ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো। হুড়মুড় করে উঠে পড়ে কাঁপুনি তুলে দেয়। এ বয়সে সব বেগই বড় তড়িঘড়ি আসে। সামলানো যায় না। মলমূত্র ত্যাগে একটু দেরি করেছ কী সব কাপড়ে–চোপড়ে হয়ে যাবে। খিদেও তাই। উঠল বাই তো কটক যাই।
গিরিজার চোখে জল আসে। পেটটা ডেকে-ডেকে কত কথা বলছে ভিখিরির মতো। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। কোলকুঁজো হয়ে কোনওক্রমে সেটাকে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না! রাস্তাঘাট সব জ্যোৎস্নায় ডুবিয়ে মায়াবী রং করে রেখেছে। তিনটে রাস্তায় তিনবার যাওয়ার চেষ্টা করে গিরিজা একই জায়গায় ঘুরে এলেন। কানাওয়ালা ধরলে এরকমই হওয়ার কথা। চেনা রাস্তায় দশবার ঘুরলেও দিকভ্রম হবে, নিজের বাসার সদর দিয়ে গেলেও চেনা যাবে না। বয়স তিয়াত্তর, এই বয়সেই ভূতেরা এসে ধরে।
–জয় রাম, জয় রাম। জয় রঘুপতি। গিরিজা বিড়বিড় করতে থাকেন।
ঠঙাৎ করে একটা শব্দ হয়। টিনের চালে কে একটা মস্ত ঢিল মারল। এ টিনের শব্দ বলে ভুল হওয়ার নয়। বাস্তবিক ঢিল। টিনের চাল থেকে ছিটকে সামনের রাস্তায় পড়ে ব্যাঙবাজির খাপড়ার মতো লাফিয়ে গিয়ে ঘাস–জঙ্গলে পড়ল। স্পষ্ট দেখা। চোখে এখনও বেশ দেখেন গিরিজা। ঢিলটা পড়তেই তারস্বরে রাম নাম করতে-করতে একটা গুদামঘরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েন। বেহায়া ভূত। বুড়ো মানুষকে নিয়ে এ কী কাণ্ড বাবা! সব জায়গাতেই বুড়ো–ধুড়ো দেখলে সকলের রসের ভাঁড়ে তুফান জাগে। রাস্তাঘাটে চ্যাংড়ারা কত পেছুতে লাগে, বাজারের দোকানিরা ‘দাদু দাদু’ বলে রঙ্গ করে, তো ভূতও বাকি থাকে কেন?
এখন হিম পড়ে বলে ছাতাটা নিয়েই বেরোন। রাতের বেলা টিউশনি সেরে ছাতমাথায় ফিরে আসেন তো লোকে পেছুতে লাগে, বৃষ্টি-বাদলা বা রোদ না হলে ছাতার মর্ম ওরা বুঝবে কি! বুড়ো হোক, আগে সব ব্যাটা বুড়ো হোক, তখন বুঝবে। ছাতাটা ফেলে এসেছেন ছাত্রীর বাড়িতে।