ছেলেবেলা থেকেই এই কানাওয়ালা ভূতটা প্রায়ই ধরে এসে গিরিজাকে। একা জুতমতো পেলেই সাঁপুটে ধরে, খুব নাকাল করে ছেড়ে দেয়। তার ওপর গিরিজার বয়স এই তিয়াত্তর পেরোল, এ বয়সে অনেক কিছুই ভোঁতা মেরে যায়। মাথার মধ্যে সব সময়ে একটা ধন্ধ ভাব।
ডাবগ্রামের এক মাথায় সরকারি গুদাম। পিপে যদি আড়াআড়ি করে আধখানা মাটিতে পোঁতা যায় তবে যেমন দেখতে হয় গুদামের চেহারা অবিকল সেরকম। লম্বা-লম্বা ঘর, টিনের ছাউনি গোল হয়ে নেমে এসেছে। সারি-সারি চল্লিশ পঞ্চাশটা গুদামঘরের ভিতরে রাস্তাটা ধাঁধা মেরে গেল। কাছেপিঠে লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। রাত্রি বাজে দশটা। চারদিক ঝিম মেরে গেছে। গিরিজা এদিক-সেদিক ঘুরলেন। খুব খিদে পেয়েছে। রাস্তা পাচ্ছেন না। গত পনেরো বছর এইসব রাস্তায় ঘুরলেন। তবু পাচ্ছেন না। ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছেন, কানাওয়ালা এক কানাভূত যাকে ধরে তাকে চেনা রাস্তায় ঘুরপাক খাওয়ায় আর আবড়ালে বসে হিহি করে হাসে। ভূতেদের যা স্বভাব। যৌবনকালে গিরিজা যখন বিজ্ঞান পড়তেন তখন বয়োধর্মে আর ভূত ভগবান মানতেন না। এই বুড়ো বয়সে আবার সেই শিশুবেলার ভয়ভীতি ফিরে এসেছে। এখন ভূতও আছে, ভগবানও আছে। গিরিজাপতি তাই কানাওয়ালাকে তাড়ানোর জন্য ডাকেন–রাম রাম! জয় সচ্চিদানন্দ রঘুপতি রামচন্দ্র। রাম হে, হরি হে–
কোথায় কী? রাস্তা-ঘাট সব গুলিয়ে গেছে। প্রচণ্ড জ্যোৎস্না প্রায় রোদ্দুরের মতো উজ্জ্বল। রাস্তায় নুড়ি–পাথরটার পর্যন্ত ছায়া পড়েছে। গুদামঘরগুলোর টিনের ছাউনিতে খটখটাং করে শব্দ হয় মাঝে-মাঝে। সে ভূতের ঢিল নয়। তিনি জানেন, সারাদিনে তেতে থাকা টিন রাতের ঠান্ডায় একটু-একটু করে সংকুচিত হয়ে আসে, তাই এ শব্দ। জেনেও কিন্তু মন মানে না, চমকে উঠে ভাবেন ভূতের ঢিল নয়তো বাবা। অ্যাঁ!
যে বাড়িতে টিউশনি করেন সে-বাড়ির কর্তা ভবেশ রায় নিজেকে বুড়োমানুষ ভাবেন। বয়স কিছু না, মোটে বাষট্টি। বিরাট অবস্থা। গোটাদুই চা বাগানের মেজর শেয়ার, গোটাছয়েক লরি, বিধান মার্কেটে ফ্যান্সি দোকান। সুখী মানুষ। প্রায়ই এসে মেয়ের পড়ার ঘরে বসে গিরিজার সঙ্গে আচ্ছা দেন। কিন্তু গিরিজার সঙ্গে ভবেশের মতের মিল হয় না। ভবেশ বলেন–বুড়ো বয়সে খাওয়া কমানো উচিত। তাই ভবেশ রায় নিজেও কম খান। একটা মধুপর্কের বাটির মাপের এক বাটি ভাত একবেলা, সকাল-বিকেল এক চিমটি করে ছানা, রাতে গোনা দু-খানা রুটি। এই খেয়েই নাকি খুব শক্ত আছেন ভবেশ। গিরিজার সেটা ভাবতেই কষ্ট হয়। অত কম খেয়ে বাঁচে নাকি লোকে? তাঁর নিজের তো অনন্ত খিদে। একগোছা রুটি আর জলের গেলাস দিয়ে বসিয়ে দিলে এই বয়সে নিদন্ত মুখে টাউটাউ করে শুধু মাড়িতে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন পলকের মধ্যে।
তবে কি গরিবেরই খিদে পায় বেশি?
আজ রাতে ভাত হবে। শালবাড়ির দিকে বিঘে চারেক জমি আছে, বর্গায় চাষ করে। সেখান থেকে পরশুদিনই আধমণ চাল দিয়ে গেছে ভালোমানুষ বর্গাদার। ক’দিন রাতের খাওয়াটা বেশ হচ্ছে। ফোঁটা ভাতের গন্ধ পাচ্ছেন যেন গিরিজা! কিন্তু কোথায় ভাত। কেবল অকাজের জ্যোৎস্না চারদিকে।
২.
আবুর কাজ বলতে দুটো, কালী সাধনা আর বকবক।
কালী সাধনা অবশ্য তার নিজের খেয়ালখুশি মতোই করে। ঘরের এক জায়গার দেওয়াল নোনায় খেয়েছে। সেই দাগধরা জায়গাটার দিকে চেয়ে সারাদিন একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে সে
রামপ্রসাদী থেকে যাবতীয় শ্যামাসঙ্গীত সম্পূর্ণ বেসুরে গায়। সাধনার শেষ দিকটায় কালী নামটা আর পুরো উচ্চারণও করতে পারে না, কেবল বলে কাঃ, কাকা, কাঃ কা কা–সে স্নান করে না, স্নানের বদলে সে রোজ সকাল-বিকেল আধ কলসি করে জল খায়। সেটা নাকি অন্তস্নান। দেহের সব ময়লা ওই জলের ঠেলায় ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। তখন গামছা দিয়ে গা মুছলেই স্নান হয়ে গেল। মাথার চুল জটা হয়ে পেছন দিকে মৌচাকের মতো ঝুলে থাকে। ওদিকে কপালের ওপর দিকটায় টাক পড়ে যাচ্ছে। উকুনের চুলকনিতেও নখের ডগায় চুল উঠে আসে। তা টাকই পড়ুক, আর জটাই ঝুলুক, আবুকে সুন্দর দেখবার কেউ নেই। বউ তার সঙ্গে থাকে না। বিয়ের পর বারো বছর কষ্টেসৃষ্টে ছিল, তারপর বাপের বাড়ির চলে গেছে। কোথায় একটা চাকরি বাকরি করে। মাস পয়লা আবার আবুর কাছ থেকেও কিছু আদায় করে নিয়ে যায়। আবু পেশকারী করে। সাধুসন্ত মানুষ বলে তার রোজগার বেশি নয়।
ইদানীং তাকে হরীতকীতে পেয়েছে। কেরোসিনওয়ালা রামু বাড়ি-বাড়ি ঘুরে সাইকেলওয়ালা গাড়িতে কেরোসিন বেচে। রামু বলে তার বয়স নাকি নব্বই। ইয়া স্বাস্থ্য, যুবকদের চেয়েও বেশি শক্তি।
আবুর আবার সকলের সঙ্গেই ভাব। সারাদিন বকবক করতে হলে তোক বাছাবাছি চলে না। প্রতিদিনই সে কিছু না কিছু অপরিচিত লোককে আপন করে ফেলে। রামুর সঙ্গে তার ভাব অবশ্য দীর্ঘকালের।
দিনসাতেক আগে রামু তাকে কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস খেতে দিয়েছিল, কচিকচি হরীতকী, বালিতে ভাজা। ভারী ভালো খেতে। ভাজা হরীতকী খেয়ে আবু মোহিত হয়ে গেল। রামু বলে–হারা খেয়ে এই নব্বই বরিষ উমরে আমার এত তাকত।
কোনও জ্ঞানই ফ্যালনা নয়। সেই থেকে আবু হরীতকীর পিছনে লেগেছে। গত সাতদিন মানুষ হরীতকীর জীবন-যৌবন-দায়িনী ক্ষমতার কথা শুনতে-শুনতে পাগল হয়ে গেল। তবু আবুর। ক্লান্তি নেই। বিধান মার্কেট আর পুরোনো বাজার ঘুরে সে ইতিমধ্যে প্রায় তিন কিলো হরীতকী এনে ফেলেছে। জামার দু-পকেট ভরতি হরীতকী নিয়ে ঘোরে, যাকে তাকে ধরে-ধরে খাওয়ায়। নিজে সবসময় মুখে হরীতকী নিয়ে ঘুরছে।