তাতে কি আপনি খুশি হবেন?
ভীষণ। ওরকম ভালো একটা মেয়ে কোনো গোলমেলে লোকের পাল্লায় পড়লে খুব কষ্ট পাব। আমি সত্যিই খুশি হব আপনি বিয়ে করলে।
কিন্তু ইতু খুশি হবে না।
কী করে জানলেন?
অভিজ্ঞতা থেকে।
কথাটার মানে বুঝলাম না।
বলছি। ইতুর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল। মোটামুটি কথা একরকম পাকাও হয়ে গিয়েছিল। গত জুলাই মাসে আমি কয়েকদিনের জন্য দেশে যাই মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করার জন্য। পরস্পরকে গ্রহণযোগ্য মনে হলে সামনের ডিসেম্বরে বিয়ে হওয়ার কথা।
কার কাকে পছন্দ হল না বলুন তো!
বলছি। ইতুর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ামাত্রই আমার ওকে ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল।
হওয়ারই কথা।
তারপর আমরা কলকাতাতেই একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করে নিজেদের সব সুবিধে আর অসুবিধের কথা পরস্পরকে জানাব বলে ঠিক হল। ফ্রি অ্যাণ্ড ফ্র্যাঙ্ক কথাবার্তা। গন্ডগোলটা ঘটল সেখানেই।
কী গন্ডগোল?
গন্ডগোলটার নাম অনিরুদ্ধ মিত্র। নামটা কি চেনা-চেনা লাগছে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নাকি? না না, অনিরুদ্ধ মিত্রকে আমি চিনি না। আপনার কি ধারণা আমি আপনার নাম পুলিশকে জানিয়ে দেব?
এটা আমার নাম তা আপনাকে কে বলল?
কেউ বলেনি, আমার অনুমান। ইতু আমার কাছে খুব করুণভাবে কনফেস করেছে যে, সে একজনকে ভালোবাসে, সে নাকি অভিমানবশে সম্পর্ক রাখছে না। হতেই পারে মশাই, হতেই পারে। ইতুর পাণিপ্রার্থী ও প্রেমিক তো আরও ছিল। অনিরুদ্ধ মিত্র তাদেরই কেউ হবে।
ইতুর বর্ণনা অনুযায়ী বেশ লম্বা, টাফ লুকিং এবং দুঃসাহসী মানুষ। পাহাড়ে চড়ে এবং পরোপকার করে বেড়ায়। বোধহয় খুব একটা বলিয়ে-কইয়ে ছেলে নয়। ইতু তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বটে, কিন্তু সেটা একটা মেয়েলি অহংকার থেকে। সে প্রত্যাশা করেছিল, নিরস্ত না হয়ে অনিরুদ্ধ ফিরে আসবে। কিন্তু অনিরুদ্ধ যে অন্য ধাতুর মানুষ, সে তা বুঝতে পারেনি। ইতু কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছে না।
কে একজন অজ্ঞাতকুলশীল অনিরুদ্ধ মিত্রকে নিয়ে কি আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার আছে মশাই?
ও হ্যাঁ, ভালো কথা। এই অনিরুদ্ধ মিত্রের সঙ্গেও ইতুর আলাপ হয়েছিল দিল্লি থেকে ফেরার পথে, পূর্বা এক্সপ্রেসে। এবং কী আশ্চর্য মিল যে, এই অনিরুদ্ধও ইতুর ফেলে-দেওয়া টিকিট কুড়িয়ে এনেছিল। চেনেন নাকি অনিরুদ্ধকে?
মেয়েটা একেবারে যাচ্ছেতাই রকমের আহাম্মক।
কার কথা বলছেন? ইতু?
আপনার মতো ছেলে, কোয়ালিফায়েড, আমেরিকায় সেটেলড, তাকে ছেড়ে কোন ঢ্যাঙা রংবাজের পেছনে ঘুরছে। ছিঃ ছিঃ! আপনি ওকে বোঝাতে পারলেন না? এক কাজ করুন, এসব মেয়েদের মনের জোর কম হয়, আপনি ওকে জোর করে বিয়ে করে আমেরিকায় নিয়ে যান তো। ভালোবাসা পেয়ে গেলে অনিরুদ্ধর ঘা শুকোতে দেরি হবে না।
জোর তো করাই যেত। ওর বাড়ির লোকরাও চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু আমার বড়ো মায়া হল। চোখ দুটো টস টস করছিল জলে।
কেলো। চোখের জল দেখেই ভুলে গেলেন? আপনি না পুরুষমানুষ।
পুরুষমানুষ তো আপনিও। ওই একরত্তি মেয়ের সামান্য কড়কানিতে ভড়কে গিয়ে তফাত হননি আপনি? জোর তো আপনিও করতে পারতেন।
না পারতাম না। গায়ের জোর ছাড়াও পুরুষমানুষের আরও কিছু জোরের দরকার হয়। যেমন লেখাপড়ার জোর, কেরিয়ারের জোর, টাকার জোর, ব্যক্তিত্বের জোর। এসব না থাকলে কীসের জোর ফলাব বলুন তো? যাই হোক, ওসব নিয়ে আর ভাববেন না। ওই অনিরুদ্ধ রংবাজের হাত থেকে যদি, ইতুকে বাঁচাতে চান। তাহলে টক করে চলে আসুন। বেচারি নিশ্চয়ই এতদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।
তাই কি? কালই তো ওর ই-মেল পেলাম।
তাতে অন্যান্য কথার পর লিখেছে, আই ডোন্ট নো হাউ লং আই হ্যাভ টু ওয়েট ফর হিম। বাট আই। অ্যাম লাভিং টু ওয়েট।
মশাই, আমি একজন চোর। কনফার্মড চোর।
আমাকে আর প্রেমের প্রলাপ শুনিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। ভোর হয়ে আসছে। এবার আমাকে সরে পড়তেই হবে। শুধু বলে যাচ্ছি, ইতুর এইসব ছেলেমানুষিকে একদম প্রশ্রয় দেবেন না। ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং। ত্যক্তোক্তিষ্ঠ পরন্তপঃ।
এর মানে কী?
মনের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে তেড়েফুঁড়ে উঠুন। মেয়েটাকে দয়া করে বাঁচান।
ওকে বাঁচানোর লোক আছে। আমার কী গরজ, বলুন?
দাঁড়ান, ওই অনিরুদ্ধ রংবাজকে একটু কড়কে দিতে হবে।
হ্যাঁ, এটা ভালো প্রস্তাব। খুব ভালো করে কড়কে দিন তো ছোঁকরাকে। তাকে বুঝিয়ে দিন যে, সে একটি মেয়ের প্রতি চূড়ান্ত অবিচার করছে।
গাড্ডায় ফেলে দিলেন মশাই।
কথা দিলেন তো।
কীসের কথা?
অনিরুদ্ধকে রাজি করাবেন।
আচ্ছা জ্বালা তো! একটা ঘড়ি চুরি করতে এসে যে বড় চক্করে পড়ে গেলাম।
কথা দিন মশাই, কথা দিন।
ঠিক আছে। ঘড়িটার কথা যেন মনে থাকে।
চার লাখ। ক্যাশ ডাউন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর শুনুন। বাবাকে আমি একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়ে এসেছি। সেটা বাবার কোনো কাজে লাগে। না, পড়ে আছে। ওটাও বাবা আপনাকে ঘড়ির সঙ্গে দিয়ে দেবেন।
ওটা আবার কেন?
আপনাদের বিয়ের যৌতুক। আগাম।
হরীতকী
আজ এই পূর্ণিমা রাতে টিউশনি সেরে ফেরার পথে গিরিজা টের পেলেন, তাঁকে কানাওয়ালা ধরেছে।
বাঘা যতীন পার্কের পাশ দিয়ে গুটিগুটি হেঁটে জ্যোৎস্না দেখতে-দেখতে দিব্যি আসছিলেন। শরৎকালের ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, শীত-শীত লাগছিল। কোনও বাড়ির বাগান থেকে শিউলি ফুলের গন্ধও ভেসে আসে, সেইসঙ্গে একটা ডাল ফোড়নের গন্ধওয়ালা জায়গাও পার হয়ে এলেন। খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। আবুর মা ওবেলা একটা ফুল মার্ক পাওয়া মোচাঘণ্ট বেঁধে রেখেছে, এবেলাও সেটা দেবে, সেইসঙ্গে ঘানির তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ডালসেদ্ধ–ভেবে একটু তাড়াহুড়ো করে হাঁটছেন। বাঘা যতীন পার্ক পেরিয়ে দুনম্বর ডাবগ্রামের রাস্তা পেরিয়ে আদিগন্ত জ্যোৎস্নায় এক নম্বর ডাবগ্রামের রাস্তায় নেমে পড়তেই টের পেলেন, রাস্তা চিনতে পারছেন না। জ্যোৎস্নারাতে মফসসলের রাস্তায় ইলেকট্রিক আলো থাকে না। তা না থাকুক, ফটফটে রাস্তাঘাট সবই দেখা যাচ্ছে। আমগাছ, জামগাছ চেনা যাচ্ছে। কিন্তু কানাওয়ালা ধরলে আর কিছু উপায় থাকে না। দশবার নিজের বাড়ির সদর দিয়ে হেঁটে গেলেও বাড়ি চেনা যায় না।