তখন আপনি কী করতেন?
না, তখনও আমি চোর হইনি। চাকরি-বাকরির চেষ্টা না করে, আমি একটা ব্যাবসা করার চেষ্টা করছিলাম। তার আগে টু-হুইলার সারানোর একটা দোকান দিয়েছিলাম পার্টনারশিপে। আমার লেবার, পার্টনারের ক্যাপিটাল। কিন্তু পার্টনার পার্টনারশিপ ভেঙে দিল। এরপর গুঁড়ো মশলা।
গুঁড়ো মশলা? অফ অল থিংস গুড়ো মশলা? কেন মশাই, টু-হুইলার ছেড়ে গুঁড়ো মশলা কেন?
আমাদের কি কোনো চয়েস আছে মশাই? এক চাক্কিওয়ালার সঙ্গে একটু ভাব ছিল। সেই আমাকে পরামর্শ দিল, সস্তার হোটেলগুলোতে প্রচুর গুঁড়ো মশলার চাহিদা। সে আমাকে সাপ্লাইয়ের লাইন ধরিয়ে দেবে। সস্তায় মশলা কিনে এনে যদি, তার চাক্কিতে পেষাই করে নিই তাহলে সে আমার ব্যাবসায়ে টাকা খাটাতেও রাজি।
ব্যাবসাটা কি চলেছিল?
হ্যাঁ। আর আশ্চর্যের বিষয় চাক্কিওয়ালা বিহারী লোকটা আমাকে সত্যিই সাহায্য করেছিল। বছর দুয়েকের মধ্যে আমার অবস্থা বেশ ভদ্রস্থ হয়ে উঠল। যে সময়ে ইতুর সঙ্গে আলাপ সেই সময়ে আমার মান্থলি ইনকাম প্রায় হাজার পনেরো টাকা নিট। ব্যাবসা ভালো চলছে, এমনকী আমি কয়েকজন এজেন্টকেও কমিশন বেসিসে কাজ দিয়েছি। আমার সংসারের হালও ফিরেছে।
আপনার ফ্যামিলি কি বড়ো?
না। সেইটেই বাঁচোয়া। বাবা মারা গেছে, ছোটোবোন আর মাকে নিয়ে আমার ফ্যামিলি ছোটোই, তবে বোনের বিয়েতে কিছু ধারকর্জ হয়ে গিয়েছিল। লাভ ম্যারেজ বলে বাঁচোয়া। নেগোশিয়েট করে বিয়ে দিতে গেলে আরও ধসে যেতাম।
এবার ইতুর কথায় ফিরুন।
হ্যাঁ হ্যাঁ। দাঁড়ান, বাথরুমের আলোটা দেখে নিই।
নিভে গেছে?
হ্যাঁ। এবার ওঁকে ঘুমোনোর সময়টুকু ছাড় দিতে হবে। তবে খুব বেশি দেরি করা চলবে না, রাত প্রায় তিনটে বাজে।
অন্তত মিনিট দশেক ছাড় দিন। অবশ্য সেফগার্ড হিসেবে আমি তো আছিই। তবু হঠাৎ মাঝরাতে একটা চেঁচামেচি হওয়াটা ভালো নয়। আমাদের পাড়ায় আবার নাইট গার্ড ঘোরে।
জানি। ওসব না জেনে কি আর কাজে নামতে হয়?
এবার বলুন।
ইতুর মামি একদিন তাঁদের ফ্ল্যাটে আমাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমি ইতুর প্রতি ইন্টারেস্টেড কি না। আমি সঙ্গে সঙ্গে কবুল করলাম যে, ইতুকে আমার ভীষণ পছন্দ। উনি তখন আমার বাড়িঘর, রোজগার এসবের খোঁজ-খবর নিলেন। আমি সব বলে দিলাম। উনি বিরসমুখে বললেন, দ্যাখো বাপু, ইতু বাপের এক মেয়ে। মামারও বড্ড আদরের ভাগনি। তোমার যা অবস্থা তাতে স্বাভাবিক নিয়মে ইতুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। তবে তোমাদের মধ্যে যদি ভাব-ভালোবাসা হয়ে থাকে, তবে গার্জিয়ানরা কেউ আপত্তি করবে না। বরং তোমারও একটা হিল্লে হয়ে যাবে।
ইতুর মনোভাব কী বুঝলেন?
সেইটেই তো গল্প। আমি একদিন ওদের বাড়ির বাইরে ইস্কুলের পথে ওর সঙ্গে দেখা করলাম। যেমনটা নিয়ম আর কী। ইতু আমাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়াল না। এমনকী রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসতেও রাজি হল। যেন এসব তার কাছে কিছু নতুন ব্যাপার নয়।
অত তাড়াহুড়োর দরকার নেই। এ জায়গাটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। একটু আস্তে ধীরে বলুন।
আপনি ভাবছেন একটা রোমান্টিক অ্যাফেয়ার? তা নয় মশাই, একেবারেই তা নয়। আমি প্রস্তাবটা উত্থাপন করতেই ইতু হঠাৎ হেসে ফেলল। তারপর একেবারে সোজা চোখে চোখ রেখে বলল, দেখুন, আপনি যে কেন ঘুরঘুর করেন তা আমি অনেক আগেই জানি। আরও কয়েকজন আমার সম্পর্কে আপনার মতোই দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমি ইন্টারেস্টেড নই। আমার জীবনে কিছু অ্যাম্বিশন আছে। মাত্র সাড়ে সতেরো বছর বয়সে আমি আমার অ্যাম্বিশন বিসর্জন দিতে পারব না। আপনি প্লিজ, এসব নিয়ে আর ভাববেন না। মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া কি বাঙালি ছেলেদের আর কোনো কাজ নেই?
ইশ, বড্ড কড়া মেয়ে তো! আপনি কী করলেন?
মনের দুঃখে ব্যাবসা বন্ধ রেখে ফের হিমালয়ে চলে গেলাম।
হিমালয়ে?
হ্যাঁ। দেখলাম কিছু বিপজ্জনক মেহনত না করলে দুর্বল মনকে জব্দ করা যাবে না। প্রায় দেড় মাস ধরে আমি বিপজ্জনক সব পাহাড়ে ট্রেকিং করে বেড়ালাম। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিই যে, মূল্যবোধ-টোধ সব বিসর্জন দিয়ে একটা ভয়ংকর কিছু করতে হবে। বিগ মানি, বিগ সাকসেস, বিগ ব্যাং। নারী-চিন্তাকে আর প্রশ্রয় দেব না। ফিরে এসে কয়েকদিন গুম হয়ে বসে নিজের মনের ট্রানজিটারি স্টেটটাকে মোটিভেট করলাম। তারপর কাজে নামলাম।
কী কাজ?
অ্যান্টিক। হীরাভাই নামে এক গুজরাটি অ্যান্টিক মার্চেন্ট আছে। তার সঙ্গে জুটলাম। হীরাভাই লোক চেনে। আমাকে তাড়াল না। বরং তালিম দিল কিছু। আমি তার হয়ে অ্যান্টিক জোগাড় করতে শুরু করি। এ-ব্যবসায়ে জালি বা দু-নম্বরি জিনিসের হাতবদলও খুব হয়। কলকাতার অ্যান্টিকের দোকানগুলোয়জালি জিনিসেরই কারবার। হীরাভাই আসল-নকল ভালো বোঝে। তার ক্লায়েন্ট বা কালেক্টররা বোকা বা শৌখিন কাস্টমার নয়। কাজেই আমাকে জিনিসের সন্ধানে নানা জায়গায় হানা দিতে হতে লাগল, নানা অদ্ভুত লোকের সঙ্গে ভাব করতে হল, বিপদেও পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এক বুড়ো পারসি তো তার একশো বছরের পুরোনো একটা চারনলা বন্দুক দিয়ে আমাকে গুলিও করেছিল।
মাই গড!
না, আমি তার জিনিস চুরি করতে যাইনি। গিয়েছিলাম দর করতে। তাই থেকে সামান্য অল্টারকেশন। বুড়োটা খ্যাপাটে গোছের। এই ব্যবসায়ে একটু-আধটু বিপদ আছেই।