হয়ওনি। কাজল গান ছাড়েনি। এখনও রেডিওতে মাঝে-মাঝে গায়, দু-একটা গানের স্কুলে মাস্টারি করে। প্রাইভেটে শেখানো তো আছেই। কিন্তু ফুলশয্যার রাতে তার কথা শুনে যেমন মনে হয়েছিল এ মেয়ে বোধহয় লতা মঙ্গেশর হবে তেমনটা কিছুই হয়নি। বরং অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশে জীবনে কিছু জটও পাকিয়েছে কাজল। তাকে বিভিন্ন ফাংশানে চান্স দিতে পারে বলে কিছু প্রভাবশালী লোকের খপ্পরে পড়ে নিজেকে নষ্ট করেছে। হৃদয় কানাঘুষো শুনেছে, কাজল নিজের পবিত্রতা বজায় রাখে না। এখানেও সেই ইনস্টিংকট। ছোট ছেলে ক্ষৌণীশকে কোনওদিনই নিজের ছেলে বলে ভাবতে পারে না হৃদয়।
মনীশ বারান্দায় এসে পাশের টুলের ওপর হৃদয়ের অভ্যস্ত ব্রান্ডের এক প্যাকেট সিগারেট আর এক বাক্স ভোটা দেশলাই রেখে বলে—কেমন আছ বাবা?
হৃদয় আজকাল কথা বলতে ভালোবাসে। কিন্তু কথায় ভেসে যেতে ভারী ভয় হয় তার। সূক্ষ্ম অনুভূতি তাকে সাবধান করে দেয়, কথা বোলোনা, বেশি কথা বললেই ওরা বিরক্ত হবে। ভাববে তুমি বুড়ো হয়েছ। তোমার ব্যক্তিত্ব নেই।
হৃদয় সতর্ক হয়। এত বেশি সতর্ক হয় যে মুখই খোলে না। ঘাড় নেড়ে জানায় ভালো।
অনীশ আমেরিকা থেকে তার ডাক্তার দাদার জন্য খুবই আধুনিক ধরনের একটা ব্লাড প্রেশারের যন্ত্র পাঠিয়েছে। সেটা প্রতিবারই সঙ্গে আনে মনীশ। আজও এনেছে। টুলের ওপর রেখে হাত বাড়িয়ে বলল—হাতটা দাও, প্রেশারটা দেখি।
হৃদয় মাথা নাড়ে, না। খামোখা দেখো। হৃদয়ের প্রেশারের কোনও গণ্ডগোল নেই। তেমন। কিছু বয়সও তো হয়নি তার। মোটে সাতচল্লিশ। একুশ বছর বয়সে সে বিয়ে করেছিল মায়ের বায়নায়। বাইশ বছর বয়সে মনীশ হয়। এখনও হৃদয়ের চেহারা ছিপছিপে, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের বেশি দেখায় না। চুল এখনও বেশ কুচকুচে কালো, চলাফেরা যুবকের মতো চটপটে। বয়সের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। তবে যে মনীশ প্রায়ই তার প্রেশার দেখে সেটা একরকম তোষামোদ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাপকে সে কোনওদিনই রোজগারের পয়সা দেয় না।
মনীশ চাপাচাপি করল না, তবে কৌতূহলভরে মুখের দিকে চেয়ে বলল—তোমার মেজাজটা আজ খারাপ নাকি?
বারান্দার ওদিকটায় নাতি-কোলে করে কাজল এসে দাঁড়াল। ওই দেখ, ওই দেখ বলে রাস্তায় আঙুল দিয়ে কী একটু দেখিয়ে ফিরে চাইল হৃদয়ের দিকে। বেশ কোমল গলায় বলল—দেখাও না প্রেশারটা। দেখাতে দোষ কী?
হৃদয় তার প্লাস পাওয়ারের চশমাটা খুলে কোলের ওপর রেখে বিতর্কের জন্য প্রস্তুত হয়ে ঠান্ডা গলায় বলে—কেন দেখাব?
এই স্বর চেনে কাজল। ভ্রূ কুঁচকে স্বামীর দিকে চায়। তার মুখের রেখা কঠিন হয়ে ওঠে। বলে–থাক থাক, দেখাতে হবে না।
মনীশ খুব চালাকের মতো বলে—বাবা, ডোন্ট মাইন্ড। জাস্ট চেক আপ করতে চেয়েছিলাম। জাস্ট চেক আপ, তা ছাড়া কিছু নয়।
কাজল ধমকে দেয়—থাক, তোকে দেখতে হবে না। যে চায় না তারটা দেখবি কেন?
হৃদয়ের ইনস্টিংকট বলল, আজকের দিনটা ভালো যাবে না। হয় দুপুরে, নয়তো রাত্রে একটা তুমুল ঝগড়া লাগবে কাজলের সঙ্গে। লাগবেই।
কাজল নাতিকে নিয়ে এবং মনীশ তার যন্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। হৃদয় বসে থেকে খবরের কাগজে চোখ বোলায়। জনতা গভর্নমেন্ট হয়তো বেশি দিন টিকবে না। ইন্দিরাও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ক্ষমতা ফিরে পাবে বলে মনে হয় না। তাহলে নাইনটিন এইট্টিতে ভারতবর্ষ শাসন করবে কে? ভূতে?
যে যুবতী মেয়েটি তাদের রান্না করে সে এসে টুলের ওপর এক কাপ চা রাখল। মেয়েটির দিকে কোনওদিনই খুব ভালো করে তাকায় না হৃদয়। তাকাতে ভরসা হয় না। মেয়েটির বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ হবে। স্বামী নেয় না বলে কসবায় বাপের বাড়িতে থেকে কাজ করে খায়। এ বাড়িতে দুবেলা রাঁধে, সারাদিন নানা কাজ করে, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে যায়। মাইনে পঁচাত্তর টাকা। রাঁধে অবশ্য খুবই ভালো। ইংলিশ ডিনার থেকে মাদ্রাজি ইডলি দোসা সবরকম খাবার করতে পারে। কিন্তু সেটা কোনও যোগ্যতা নয়। আসল যোগ্যতা হল, ওর বয়স। চমৎকার বয়স। চেহারাখানা রোগাটে হলেও খাঁজকাটা শরীরের একটা লাবণ্য আছে। মুখখানা মোটামুটি। আগে উলোলো ঝি-র মতো আসত। এখন সাজে। পরিপাটি করে বাঁধা চুল, চুলে লাল নীল ফিতে, কপালে টিপ। হৃদয়ের সামনে আসবার আগে মুখখানা যে আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছে আসে তা হৃদয় ইনস্টিংকট দিয়ে টের পায়।
আজও পেল। খবরের কাগজের ডানদিকের পাতায় কোণাচে একটা খুনের খবরে চোখ রেখেও হৃদয় বুঝতে পারে ললিতা তার দিকে খুব নিবিড় চোখে চেয়ে আছে। একটু চাপা গলায়, যেন গোপন কথা বলার মতো করে বলল—আপনার চা।
গভীর শ্বাস ছেড়ে হৃদয় বলে।–হুঁ
লক্ষ করেছে হৃদয়, বয়সে যথেষ্ট ঘোট হলেও ললিতা তার বউকে বউদি আর তাকে দাদা। বলেই ডাকে। আবার মনীশ আর তার বউকে বলে বড়দা আর বড়বউদি! কাজল বলে-বলেও তাকে আর হৃদয়কে মাসি-মেশোর গোছের কিছু ডাকাতে পারেনি ললিতাকে দিয়ে। এসবই একরকম ভালো লাগে হৃদয়ের। একটা গোপন অবৈধ তীব্র অনুভূতি। ললিতা তাকে মেসো বলে ডাকলে হয়তো এই অনুভূতিটা হত না তার।
কাজল গানের স্কুল বা টিউশনিতে যায়। ছুটির দিনে ফাঁকা বাড়িতে কত দিন একাই থাকে হৃদয় আর ললিতা। কোনওদিন হৃদয় সচেষ্ট হয়নি। ললিতাও না। তবে দুজনকে ঘিরে একটা তীব্র অনুভূতির বৃত্ত যে বরাবর তৈরি হয়েছে এটা ইনস্টিংকট দিয়ে কতবার টের পেয়েছে হৃদয়। কিন্তু বাইরে ভালোমানুষ এবং ভিতরে এক শয়তান হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া সে আর কীই বা করতে পারে?