এই পর্যন্ত কোনো গোলমাল হয়নি। কিন্তু রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ঢুকেই বটু একটা বালতি না কীসে যেন ধাক্কা খেয়ে, একগোছা থালা ঝনঝন করে ফেলল। তার এমনি আওয়াজ যে, মড়া মানুষরাও উঠে বসে।
কোনোরকমে সেখান থেকে ছুটে বসবার ঘর অবধি এসেছি, আর ততক্ষণে চারদিকে হইচই। ছোটোদাদু লাঠি নিয়ে, টর্চ নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। ধরলে আর আস্ত রাখবেন না। একবার টর্চটা আমাদের মুখে পড়লেই আমার ছুটিতে মজা মারা সারা! অন্ধকারে শাখটা তখনও জ্বলজ্বল করছে। এক দৌড়ে সেটাকে বুকে নিয়ে আস্তে একটু ফুঁ দিলাম। অমনি সারাবাড়িময় গম গম করে উঠল। মনে মনে বললাম, এইবার দেখি তোমার কত ক্ষমতা। ওমা! ওকথা ভাবামাত্র শাখটা আপনি-আপনি আমার হাত থেকে সুড়ত করে ছুটেগিয়ে, একেবারে ছোটোদাদুর পায়ের উপর! আর কী! ওরে বাবারে, বোমা ফেলল নাকি রে, মরে গেলাম রে, জল আন রে! দেখতে দেখতে চারিদিকে লোকজন গিজগিজ করতে লাগল। সেই সুযোগে বটু আর আমি খাবার ঘর থেকে লম্বা।
পেনেটিতে
পেনেটিতে, একেবারে গঙ্গার ধারে, আমার বড়ো মামা একটা বাড়ি কিনে বসলেন। শুনলাম বাড়িটাতে নাকি ভূতের উপদ্রব তাই কেউ সেখানে থাকতে চায় না। সেইজন্য বড়ো মামা ওটাকে খুব সস্তাতেই পেয়েছিলেন।
যাই হোক, বিয়ে-টিয়ে করেননি, আপত্তি করবার লোকও ছিল না। মেজো মাসিমা একবার বলেছিলেন বটে, নাই-বা কিনলে দাদা, কিছু নিশ্চয়ই আছে, নইলে কেউ থাকে না কেন?
বড়ো মামা রেগেমেগে বাড়ির কাগজপত্র সই করবার আগে ওঁদের কুস্তির আড্ডার দু-জন যাকে নিয়ে সেখানে দিব্য আরামে দু-রাত কাটিয়ে এলেন। যাদের অবিশ্যি সবকথা ভেঙে বলা হয়নি। তারা দু-বেলা মুরগি খাবার লোভে মহাখুশি হয়েই থাকতে রাজি হয়েছিল। পরে আড্ডায় ফিরে এসে যখন বড়ো মামা ব্যাপারটা খুলে বলেছিলেন তখন তারা বেজায় চটে গিয়েছিল। যদি কিছু হত দাদা? গায়ের জোর দিয়ে তো ওনাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যেত না!
দু-মাস পরে বড়ো মামা সেখানে রেগুলার বসবাস শুরু করে দিলেন। সঙ্গে গেল বন্ধু ঠাকুর, তার রান্না যে একবার খেয়েছে সে জীবনে ভোলনি; আর গেল নটবর বেয়ারা, তার চুয়াল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, রোজ সকালে-বিকেলে আধ ঘণ্টা করে দুটো আধমনি মুগুর ভাজে। আর ঝগড়ু জমাদার, সে চার-পাঁচ বার জেল খেটে এসেছে গুন্ডামি-টুন্ডামির জন্য। এরা কেউ, শুধু ভূত কেন, ভগবানেও বিশ্বাস করে না।
আমরা বরানগরে ছিলাম, আমি ক্লাস নাইনে পড়ছি। এমন সময় বাবা পাটনা বদলি হয়ে গেলেন আর আমার স্কুল নিয়েই হল মুশকিল। বড়ো মামা তাই শুনে বললেন, কুছ পরোয়া নেই, আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, এমন কিছু দূরও পড়বে না। ব্যাটা বন্ধুর রান্না খাবে আর আমিও আমার নতুন কবিতাগুলো শোনাবার লোক পাব, বন্ধুরা তো আজকাল আর শুনতে চায় না। ভালোই হল।
শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল। মা-রা যেদিন সকালে পাটনা চলে গেলেন, আমার জিনিসপত্র বড়ো মামার ওখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল, আর আমিও সারাদিন স্কুল করে বিকেলে গিয়ে সেখানে হাজির হলাম।
মনটা তেমন ভালো ছিল না, মা-রাও চলে গেছেন আবার আমাদের ক্লাসের জগু আর ভুটে বলে দুই কাপ্তেন কিছুদিন থেকে এমনি বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল যে, স্কুলে টেকা দায় হয়ে উঠছিল। আগে ওরাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল, কিন্তু পুজোর ছুটির সময় সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ওরা এমন প-এ আকার ছোটোলোকের মতো ব্যবহার আরম্ভ করেছিল যে, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন ওরাই হলেন ফুটবলের ক্যাপ্টেন, ক্লাবের সেক্রেটারি। সে দিনও ওদের সঙ্গে বেশ একটা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে; সে আবার অঙ্ক ক্লাসে। আমার একার দোষ নয়, কিন্তু ধরা পড়ে বকুনি খেলাম আমিই। ওরা দেখলাম খাতার আড়ালে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসছে।
বাড়ি এসেও মনটা একটু খারাপই ছিল। একেবারে জলের মধ্যে থেকে ঘাটের সিঁড়ি উঠে গেছে বারান্দা পর্যন্ত। বিশাল বিশাল ঘর, ঝগড়ু আর নটবর তকতকে করে রেখেছে। প্রায় সবগুলোই খালি, শুধু নীচের তলায় বসবার ও খাবার ঘরে আর দোতলায় দুটো শোবার ঘরে বড়ো মামা কয়েকটা দরকারি আসবাব কিনে সাজিয়েছেন।
কেউ কোথাও নেই। বড়ো মামাও কোথায় বেরিয়ে গেছেন। নীচে থেকে বন্ধুর রান্না লুচি-আলুরদম খেয়ে উপরে গেলাম। বই রেখে, আমার ঘরের সামনের চওড়া বারান্দা থেকে দেখি বাগানময় ঝোপঝাপ; আম গাছ, কাঁঠাল গাছও গোটাকতক আছে। গঙ্গার ধার দিয়ে জবা ফুলের গাছ দিয়ে আড়াল করা একটা সরু রাস্তা একেবারে নদীর কিনারা ঘেঁষে চলে গেছে। সেখানে তিনজন মাঝি গোছের লোক মাছ ধরার ছিপ সারাচ্ছে। একজন বুড়ো আর দু-জন আমার চেয়ে একটু বড়ো হবে। ওখানকারই লোক বোধ হয়। আমাকে দেখতে পেয়ে তারা নিজের থেকেই ডাকল। দেখতে দেখতে বেশ ভাব জমে গেল। ওরা বললে, পিছন দিকের পুকুরে আমাকে মাছ ধরা শেখাবে, শনিবার নদীতে জাল ফেলবে, নিশ্চয় নিশ্চয় যেন আসি। বুড়োর নাম শিবু, ছেলে দুটো ওর ভাইপো, সিজি আর গুজি।
বেশ লোকগুলো। বাড়ির মধ্যে আসত-টাসত না, চাকরবাকরদের এড়িয়ে চলত, কিন্তু আমার সঙ্গে খুব দহরম-মহরম হয়ে গেল। আমাকে সাপ কামড়ানোর ওষুধ, বিছুটি লাগার ওষুধ এইসব শিখিয়ে দিল। আমাদের বাগানেই পাওয়া যায়।