সকলে তো থ! বুড়ো লোকটিও কালো পাথরটাকে ট্যাকে গুঁজে জঙ্গলের দিকের পথ ধরল। তখন সকলের চোখ চকচক করে উঠল, সোনা থাকলে দুর্ভিক্ষেরও কোনো ভয় থাকবে না। চারদিক থেকে একটা ধর, ধর, গেল, গেল রব উঠল। বুড়ো লোকটি এক বার ওদের মুখের দিকে তাকাল, তারপর একটা লাফ দিয়ে হরিণ হয়ে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বোগি রুমু কিচ্ছু বলল না।
ঝগড়ু বললে, বলো এ-ও অসম্ভব।
বোগি বালিশে মুখ গুঁজে বললে, অসম্ভব হবে কেন?
ঝগড়ু তো অবাক! এমনি সময় দাদু আর দিদিমা শ্যামলবাবুদের বাড়ি থেকে ফিরে এলেন। সে এক কাণ্ড শুনে এলাম রে। রামহাটি স্টেশনে কে একটা জাদুকর নানারকম খেলা দেখাচ্ছিল, দেখতে দেখতে দারুণ ভিড় জমে গেল, তারপর কী নতুন খেলা দেখাবে বলে সে এর ঘড়ি ওর আংটি, তার টর্চ সব নিয়ে দে লম্বা! ওই ভিড় স্টেশনের মধ্যে একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল, সবাই মিলে আঁতিপাঁতি খুঁজেও তার টিকিটি পেল না। কিন্তু তোদের ঘুমুবার সময় হয়ে গেছে, তোরা এখন ঘুমো।
অনেকক্ষণ পরে রুমু বললে, দাদা!
–কী?
–টর্চ তো ছিল না ওর কাছে।
বোগি চুপ করে রইল। রুমু আবার ডাকল, দাদা!
–কী বল?
–ওর কপাল কেটে গিয়েছিল।
বোগি বললে, আঃ, রুমু, ফের কাঁদছ কেন?
–রক্ত বেরোচ্ছিল যে দাদা, টর্চের আলোতে দেখলাম।
বোগি রুমুর পিঠে মুখ গুঁজে চুপ করে শুয়ে রইল।
ঘড়ির শব্দ দূরে সরে যেতে লাগল। আরও দূরে বাঁধের উপর মালগাড়ি যাচ্ছিল টংলিং টংলিং টংলিং।
পরদিন সকালে মালীর ঘরে গিয়ে বোগি রুমু দেখল, দড়ির খাটে টর্চটা রয়েছে, আর একটা ছোটো বাঁশি। লোকটা নেই।
পঞ্চমুখী শাঁখ
বটুদের দেশের বাড়িতে একটা প্রকাণ্ড পঞ্চমুখী শাঁখ আছে। শুনেছি শাঁখটা নাকি দেড়-শো বছর ধরে ওদের বাড়িতে রয়েছে। ওর নানারকম গুণটুনও নাকি আছে। আগে রোজ ওর পুজো হত, পুরুতঠাকুর আসত, খাওয়া-দাওয়া হত। তবে সত্তর বছর হল পুজো-টুজো সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ওটা বসবার ঘরের তাকের উপর সাজানোই থাকে। দু-পাশে দুটো কাচের ফুলদানিতে কাগজের ফুল থাকে, আর মাঝখানে শাঁখটা পাঁচটা শিং তুলে চকচক করে। রংটা ফিকে কমলা লেবুর মতো, দারুণ ভারী, আর সারা গায়ে কেমন একটু ধূপধুনোর গন্ধ।
গত বছর পুজোর সময় কয়েক দিনের জন্য ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। শাঁখটা দেখে আমি তো অবাক। শাঁখ যে আবার এত প্রকাণ্ড হয় তা আমার জানা ছিল না। ঘরে কেউ ছিল না, আস্তে আস্তে গিয়ে ওর গায়ে একটু হাত বুলোলাম, কী সুন্দর পিছলা-পিছলা মনে হল। এমন সময় পিছন থেকে বটুর ছোটোদাদু বললেন, একটু ধরতে ইচ্ছে হয় তো ধরো। কিন্তু খবরদার যেন আবার বাজিয়ে বোসো না, হাঁ, তাহলেই সাংঘাতিক কাণ্ড হবে। ওটাকে শেষ বাজিয়েছিলেন আমার ছোটো ঠাকুরদা। তারপর থেকে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস, ঠিক ওইখানটিতে তার লাল মখমলের চাপকান, চুড়িদার ইজের আর নাগরা জুতোজোড়া পড়ে ছিল। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে থেকে ছোটো ঠাকুরদা একেবারে বেমালুম নিখোঁজ। সেই থেকে আর ও শাঁখ বাজানো হয় না।
আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে একটু সরে দাঁড়ালাম। ছোটোদাদু বললেন, না বাজানো অবধি কোনো ভয় নেই। ওই শাখটা কি এ-বাড়ির জন্য কম করেছে। এ গুষ্টির যা কিছু, একরকম সবই বলতে গেলে, ওই শাঁখেরই দয়ায়। তারপর কেন যে বিগড়ে গিয়ে ও সর্বনাশটি করল কে জানে। দেখিস আবার ফেলে-টেলে দিসনে যেন। আঙুলও ঘেঁচে যাবে, আবার কী হতে গিয়ে শেষটা কী হয়ে যাবে। এই বলে ছোটোদাদু ঘরের কোনা থেকে লাঠিগাছি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
পরে বটুর কাছে আরও শুনলাম। সত্যি অদ্ভুত ব্যাপার। দেড়শো বছর আগে ওদের কে একজন পূর্বপুরুষ মেলা ধারধোর করে শেষটা পাওনাদারদের তাগাদার চোটে সন্ন্যাসী হয়ে সটান রামেশ্বর। সেখানে গিয়ে ওই অত বড়ো মন্দির, যার বারান্দাটাই শোনা যায় চার হাজার ফুট লম্বা। আর তার মধ্যে থাকে থাকে তেত্রিশ কোটি দেবতার মূর্তি সাজানো, এইসব দেখে তার মনের একটা ভারি পরিবর্তন হল। গেলেন সমুদ্রের ধারে, স্নান সেরে এক বার পুজো দেবেন।
সে কী বিশ্রী সমুদ্রের ধার, সে আর কী বলব। একেবারে জলের কাছাকাছি পর্যন্ত এবড়ো-খেবড়ো গাছগাছালি, জলে মোটে ঢেউ নেই, তীর ঘেঁষে শ্যাওলা পড়েছে, আর সে যে কী বিশ্রী একটা আঁশটে গন্ধ। কিন্তু মনের বদল হয়েছে, এখন তো আর ওসব ভাবলে চলবে না। বটুর পূর্বপুরুষ একটা গামছা পরে, তারই মধ্যে ঝুপঝাঁপ করে নেমে পড়লেন। ও মা, পায়ের আঙুলে আবার কুটকুট করে কামড়ায় কীসে? পূর্বপুরুষ সেখান থেকে খানিকটা সরে গিয়ে স্নানের চেষ্টা দেখতে লাগলেন। কিন্তু কী জ্বালা! আবার আঙুলে কীসে কুটকুট করে কামড়ায়! কী আপদ! এ-রকম করলে তো মন বদলানো মুশকিল! পূর্বপুরুষ বিরক্ত হয়ে জল থেকে উঠে পড়লেন।
বালিটুকু পার হবেন, এমন সময় পিছনে একটা সরসর শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন এ কী কাণ্ড! একটা বিরাট পাঁচমুখী শাঁখ কুকুরবাচ্চার মতো পিছন পিছন আসছে। এখন কী করা যায়! শাখটাকে তাড়া দিলেও যায় না। পূর্বপুরুষের শুকনো ধুতির খুটে বাঁধা একটু মুড়ি-নারিকেল ছিল তাই খানিকটা ছুঁড়ে দিলেন, অমনি গুড়গুড় করে এগিয়ে এসে শাঁখটা সেটার উপর চেপে বসল।