বুঝতেই তো পারছ এসব কথা বড়োদের কাছে মোটেই বলবার মতো নয়। তার পরদিন সন্ধ্যে বেলা ফাগু মুঠোর মধ্যে করে কী একটা ছোট্ট লাল বিচি আর একটা তামার আংটি দেখাল। কী রে ফাগু, ও দিয়ে কী হবে? ফাগু বলল, আংটি পরে ওটা খেলে, তারপর যদি আমার জানা একটা মন্তুর মনে মনে বলা যায় তাহলে যখনই ইচ্ছা হবে তখুনি আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারব। এর অনেক বিপদও আছে, কাজেই তোমরা যেন আবার খেতে-টেতে চেয়ো না। এই-না বলে আমাদের সামনেই টপ করে সেটাকে গিলে ফেলল। আরেকদিন, দেখি পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা তামার মাদুলি বাঁধা। বলে কি না, ওটা যতক্ষণ আমার পায়ে পরা থাকবে, ততক্ষণ সব জন্তু-জানোয়ারদের কথা আমি বুঝতে পারি, দিদি। নগা বিরক্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই বই কী, এদিকে ক খ পড়তে পারেন না, বাড়িতে চিঠি লিখতে হলে আমাকে এসে খোশামুদি করেন, উনি বুঝবেন জন্তু-জানোয়ারদের ভাষা!
আমার ছোটো মামাতো বোন টিনা বলল, সsপ্যাকে বলেন নগজ পানা, রেফ্রিজারেটরকে বলেন ক্যাবেন্ডিস, ইলেট্রিককে বলেন লিকটিস, উনি বাঘা পুষিদের কথা বুঝবেন। ফাগু একটু কাষ্ঠহেসে বলল, দেখো দিদি, পরিদের ইংজিরি শিখবার দরকার হয় না, ওই যে কাল মাস্টারবাবু তোমাদের বকতেছিলেন বাঁশ বেয়ে বাঁদর ওঠে বুঝতে পারছিলে না বলে, ও সবও আমাদের শিখতে হয় না। আমাদের দেশে আমি নিজের চোখে দেখেছি বাঁদররা বাঁশ বেয়ে বেয়ে ওঠানামা করতেছে। একটুখানি ওঠে আবার একটুখানি করে পিছলে পড়ে যায়, আর রেগেমেগে সে যা বলাবলি করতেছে, সে আর তোমাদেরকে না বলাই ভালো, কোন ফাঁকে কী শিখে নেবে। হ্যাঁ, কী বলছিলাম, জন্তুদের কথা বুঝি বই কী। এই তো একটু আগে পুষি বলছিল, খোকাবাবু হাত ধুয়েই পিসিমার বাটি থেকে দুধ চুরি করে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। অত হাসছ কী দিদি? কাল বাঘাকে কে ওই পুজোর সময় ছেড়ে দিয়েছিল সেকথাও বাঘার কাছে শুনেছি।
এর পর ফাগুকে আমরা খুব বেশি ঘাঁটাতাম না। কিন্তু সত্যি ব্যাটার খাওয়ার আর ঘুমের বহর দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। মাঝে মাঝে আমাদের বলত, দেখো, দাদা দিদি, তোমরা যদি আমাকে খুশি করতে পার তোমাদের আমি ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মন্তরটা শিখিয়ে দেব। আমরা তখুনি ওকে আমাদের পয়সা-কড়ি যার যা হাতে ছিল দান করে বসলাম। এবার খুশি হয়েছ তো ফাগু, এবার শিখিয়ে দাও। ফাগু বলত, হ্যাঁ, হা, শিখিয়ে দেব বই কী। তবে একটা কালো প্যাঁচার চোখের মণি লাগবে। সেটা আনতে পারবে তো? আমরা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে এ ওর দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। শেষে নগা বললে, কী যে বল ফাগু, প্যাঁচার চোখ কোথায় পাব? আচ্ছা এই কালো মার্বেলটাতে হবে না? ফাগু একটু ভেবে বলল, তা হতে পারে, পরিদের ছেলে আমি, ওটা শক্ত হলেও আমার পক্ষে অসম্ভব নয়, কিন্তু তাহলে যে আবার জ্যাঠামশাইএর ওই ভালো তামাকটার এক দলা লাগবে। আর দেখ খোকাবাবু, কাউকে যদি এসব কথা বল তো মন্তর তো হবেই না, বরং পড়া-টড়া যা একটু-আধটু জান তাও সব ভুলে যাবে। নগা বলল, পাগল, পাগল, এসব কথা কাউকে বলি কখনো!
তামাক পেয়ে ফাগু বলল, আজ তো হবে না, খোকাবাবু, আজ সকালে পশ্চিম দিকে ছাগল ডেকেছিল, আজ হবার নয়। কাল বিদ্যুৎবার, কাল বাদ দিতে হবে; পরশু একাদশী, পরশু মন্তর-তন্তর করলে ম্যালেরিয়া হয়, সেই গিয়ে একেবারে শনিবার করতে হবে। তা একদিক দিয়ে ভালো হল, সেদিন ছোটোকাকিমাও বাপের বাড়ি থেকে আসবেন, ওনার সঙ্গে সেই দুষ্টু বিজুও আসবে, ওকেও তা হলে শিখিয়ে দিতে পারব। আচার-টাচার চুরি করতে ভারি সুবিধে হবে।
তাই হল। কোনোরকমে বিস্যুৎ শুক্কুরটা পার করে শনিবার সকালে যেই ছোটোকাকিমার সঙ্গে বিজু এসে উপস্থিত হয়েছে, ধরলাম গিয়ে ফাগুকে। নগা বললে, আর চালাকি চলবে না, ফাগু, বলে রাখলাম। যা যা বলেছিলে সব হয়েছে। এবার না শিখিয়ে দিলে কিন্তু বাবাকে বলে-টলে একাকার করব, সে পড়াই ভুলি আর যাই করি। আমি বললাম, হ্যাঁ রে, সত্যিই তাই। তা ছাড়া এমনিতেই তো প্রায় সব ভুলে গেছিস, মাস্টারমশাই বলছিলেন-না? খুশি হওয়া দূরে থাকুক নগা আমাকে এক ধমক দিল, চুপ। আমি তোর চেয়ে বড়ো-না! বিজু বললে, আহা, তোরা থাম-না। দেখ ফাগু, পড়া-টড়ার জন্য আমি কেয়ারই করি না। জানিই না কিছু, ভুলব কী ছাই! তবে এটুকু বলে রাখি চালাকি করবি তো পিটিয়ে ছাতু করে দেব। তোর চেয়ে ঢের ঢের ভালো লোকদের একেবারে আমচুর বানিয়েছি তা জানিস? যখন শেষটা ছেড়ে দিয়েছি পানের মশলার সঙ্গে তাদের কোনো তফাত থাকেনি। কঁদতে কাঁদতে সব বাছাধনরা বাড়ি গেছে!
ফাগু বলল, আরে না, না। অত অবিশ্বাস করলে কি চলে, দাদা? আজ সন্ধ্যা বেলায় সুয্যি ডুববার এক ঘণ্টা পরে খুব ভালো সময়। তোরা চার জনে একটা নতুন কাঁসার ঘড়ায় পঞ্চাশটা সন্দেশ, একটা নতুন ধুতি, একটা নতুন গামছা, আংটিটা তো আমার পকেটেই আছে– বলে ফাগু এ-পকেট সে-পকেট হাতড়াতে লাগল। সব্বনাশ আংটি তো নেই! তার কী হবে! এমনি আংটিতে তো হবে না, ওটা যে মন্ত্রপূত ছিল।
–অ্যাঁ ফাণ্ড! শেষ কালটা সব পণ্ড! বিজু ঘুসি পাকিয়ে বলল, দেখ, চালাকি রাখ, আংটি যখন তুই হারিয়েছিস তোকেই ব্যবস্থা করতে হবে। এক মিনিট সময় দিলাম। ফাগু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, লাল পাথর-বসানো বড়ো সোনার আংটি একটা হলেও চলে যায়। তা সে আমি কোথায় পাব? বিজু একটু হেসে বলল, আচ্ছা, সে আমি দেবখন। কিন্তু অদৃশ্য হতে শেখাতে হবে।