বুড়ো বাঁদর খানিকক্ষণ ধরে চাকটাকে খুব নজর করে দেখল। তারপর গম্ভীর মুখ করে বাঁ হাতের তেলো দিয়ে বেরুবার গর্তটাকে চেপে ধরল। ছানা বাঁদর দূর থেকে হাঁটুর উপর হাতের ভর দিয়ে কাণ্ড দেখতে লাগল। যেই-না ভিতর থেকে একটা বোলতা বেরুতে চায়, বুড়োর হাতে সুড়সুড়ি লাগে বোধ হয়, আর অমনি সে হাতটা একটুখানি ফাঁক করে ডান হাত দিয়ে খপ করে বোলতাটাকে ধরে, দাঁত দিয়ে কামড়ে মুণ্ডু ছিঁড়ে নিয়ে, বোলতাটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। হাতের তেলোর চামড়া এমনি পুরু যে তাই বোধ হয় বোলতারা আর হুল ফুটোতে পারে না!
তাঁবু থেকে মুকুন্দবাবু অবাক হয়ে দেখলেন যে দেখতে দেখতে বাঁদরের পায়ের কাছে, ছোটোখাটো একটা বোলতার টিপি জমে গেল। ছোটো বাঁদরটা তখনও মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তারপর মুকুন্দবাবুরা কাপড়চোপড় পরে, দলবল নিয়ে শিকারের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
ফিরলেন সেই সূর্য ডোবার সময়, ক্লান্ত শরীরে। তাঁবুতে ফিরে, স্নান সেরে, বাইরে এসে ডেক চেয়ারে পা মেলে দিয়ে বসলেন। চারিদিকে ফুটফুট করছে জ্যোত্মা। হঠাৎ মুকুন্দবাবু দারুণ চমকে উঠলেন। কী সর্বনাশ, ওই না ছানা বাঁদরটা এখনো সেইখানে দাঁড়িয়ে উত্তেজনার চোটে একবার এ পায়ে, একবার ও পায়ে লাফাচ্ছে!
বুড়ো বাঁদরও বোলতার চাকের তলায় বসে, আর তার পাশে দেড় হাত উঁচু একটি বোলতার পাহাড়! তখনও সে একমনে একটির পর একটি বোলতা কামড়ে চলেছে। যতক্ষণ মুকুন্দবাবু জেগে রইলেন বাঁদর দুটোও নড়ল না।
তারপর ওঁরা তো খেয়ে-দেয়ে শুতে গেলেন। পরদিন সকালে উঠে দেখেন, বাঁদর দুটো কখন চলে গেছে। বোলতার চাকের তলায় একটা বোলতার পাহাড়। আর সকাল বেলার রোদে প্রজাপতিরা উড়ছে, পাখিরা কিচিরমিচির করছে, কিন্তু বোলতাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই।
গুণ করা
বুঝলে, আমার মামাবাড়িতে ফাগু বলে একটা চাকর ছিল। বাঙালি নয়; ওই গারো পাহাড় অঞ্চলে ওর বাড়ি। আশা করি গারো পাহাড় কোথায় সেকথা আর তোমাদের বলে দিতে হবে না। ফাগু যে বাঙালি নয় সে ওকে দেখলেই বোঝা যেত। বেঁটে, মোটা, একমাথা কাটা কাটা চুল, দারুণ ফর্সা, আর খেত যে, আরে বাপ, দেখলে তোমাদের তাক লেগে যেত। রোজ দু-টি বেলা এক-গন্ধমাদন পর্বত ভাত আর একগঙ্গা জল তার চাই। তাই দেখে আমরা হাসাহাসি করলে আবার সে কী রাগ!
– অত হাসবার কী আছে দিদি? জান, আমরা হলাম গিয়ে পরিদের বংশ। আমরা নানারকম তুকতাক ভেলকি মন্তর জানি, একটু না খেলে আমাদের চলবে কেন?
একদিন আমার মামাতো ভাই নগা বলল, দ্যুৎ? পরি আবার হয় নাকি? যত সব বানানো গল্প। চালাকি করবার আর জায়গা পাওনি। তাই শুনে ফাগু এমনি চটে গেল যে আরেকটু হলেই থালায় একপাহাড় ভাত ফেলেই উঠে যাচ্ছিল। নেহাত অত ভাত খেলে বেড়ালটার অসুখ। করতে পারে বলেই গেল না। কোনো কথা না বলে পাহাড়টিকে শেষ করে, এক কলসি জল গিলে, তারপর আবার বলল, তোমরা জানই-বা কী আর বোঝই-বা কী? ইস্কুলে গিয়ে কয়েকটা বই মুখস্থ করে নিজেদের সব মস্ত পণ্ডিত মনে কর। বলি, একটা তেঁতুল পাতাকে বাঘ বানিয়ে দিতে পার?
নগা বলল, হ্যাঁ, তুমি পার না তো আরও কিছু! একটা থালা মাজতে পার না, পিসিমার কাছে তাড়া খাও, তুমি আবার বাঘ বানাবে! ফাগু ব্যস্ত হয়ে বলল, আস্তে, খোকাবাবু, আস্তে। বড়োরা শুনতে পেলে আমাকে আস্ত রাখবে না। নগা বললে, কেন, আস্ত রাখবে না কেন?
–আরে আমার ঠাকুরদা শুধু যে তেঁতুল পাতাকে বাঘ বানিয়ে দিতে পারত তা নয়, তার উপর সুতো বেঁধে মানুষকে ছুঁচো বানিয়ে দিতে পারত। মানুষকে ছুঁচো বানাত বললেই হল! কক্ষনও মানুষকে ছুঁচো বানাত না।
ফাগু বলল, আহা, ছুঁচো বানাত তো আর বলিনি, বানাতে পারত। খুব দয়ালু ছিল তাই বড়ো-একটা বানাত না। তবে মানুষকে হঁদুর ব্যাং কাচপোকা বানিয়ে দিতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।
শুনে আমরা সবাই একেবারে থ মেরে গেলাম। ফাগু আরও বললে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পাহাড়ের নীচেকার গায়ের চমরু মোড়ল ঠাকুরদার কাছে টাকা ধার করে শোধ দিচ্ছিল না বলে, ঠাকুরদা প্রথমে সর্টে পুড়িয়ে তাকে আমাদের বাড়িতে এনে, তারপর তার চারদিকে সুতো বেঁধে মন্ত্র পড়ে, তাকে একটা ব্যাং বানিয়ে, একটা মাটির হাঁড়িতে সরা চাপা দিয়ে রেখে দিলেন। তারপর চমরুর বউ হাউমাউ করে কেঁদেকেটে এসে টাকা শোধ করে দিয়ে গেলে, তবে ঠাকুরদা আবার চমরুকে মাথায় ঘুঁটের ছাই মাখিয়ে মানুষ করে দিলেন। ওইজন্যই বার বার বলি, খোকাবাবু, আমার পিছনে লেগ না।
নগা মাঝে মাঝে ফাগুর মাথার টিকি ধরে টানত কি না, তাই ফাগু ও-রকম বলল। নগা যদিও মুখে বলল, হাঃ! উনি সবকিছু করতে পারেন, অথচ দশ টাকা মাইনেতে বাড়িঘর ছেড়ে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছেন! মুখে একটু চাল দিল বটে কিন্তু টিকিতে হাত দিল না।
ফাগু আস্তে আস্তে উঠে থালা-ঘটি নিয়ে আঁচাতে গেল; যাবার সময় শুধু বলল, টাকাপয়সা তৈরি করতে পারি একথা তো বলিনি, খোকাবাবু। সে আমার ঠাকুরদাদাও পারত না। আর সে যা পারত, আমার বাবা অতটা পারত না। আবার আমি পারি আরও কম। তবে একেবারে যে কিছুই পারি না তাও নয়। দেখাব এখন একদিন। এখন তোমরা কেটে পড়ো দিকিনি। চাকর-বাকরদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম মোটই ভালো নয়।