আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গুপির দিকে তাকালাম। কামার কোথায় পাব? গুপি বললে, চলুন, আগে একটা সাইকেল মেরামতের দোকান আছে, তাদের আমি চিনি, তারা করে দিতে পারবে মনে হচ্ছে।
তাহলে ওঠ। বাপ, ওঠ। আর সময় নেই।
দু-জনে গাড়ির মধ্যে ভদ্রলোকটির পাশে উঠে বসলাম। মখমলের সব গদি। থিয়েটারের লোকেরা আছে বেশ! আর ভুরভুর করছে আতরের তামাকের গন্ধ। ভদ্রলোকের সঙ্গে মেলা দলিলপত্রও রয়েছে দেখলাম।
গুপি বাতলিয়ে দিল, বাঁয়ে ঘুরে ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে পথ, আস্তে আস্তে চলোম। ঘোড়ার পায়ে ব্যথা লাগে। ছোট্ট গলির মধ্যে দোকান। অত বড়ো চার ঘোড়ার গাড়ি তার মধ্যে ঢুকবে না। ঢুকলেও আর ঘুরবার উপায় থাকবে না। ভদ্রলোক কেবলই তাড়া দিতে লাগলেন, দেরি করলে নাকি নন্দকুমার নামের একটা মানুষের প্রাণ যাবে। তখন গুপি নাল হাতে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে বলল, এইখানেই দাঁড়ান, আমি গিয়ে যন্ত্রপাতিসুন্ধু শম্ভকে ডেকে আনি। তুই আয় আমার সঙ্গে। অগত্যা দু-জনেই নামলাম। শম্ভকে ঠেঙিয়ে তুলতে একটু দেরি হল। তারপর প্রথমটা কিছুতেই বিশ্বাস করে না। চার ঘোড়ার গাড়ি আবার কী? এ তল্লাটে কোথাও চার ঘোড়ার গাড়ি হয় না। একটা চার-ঠ্যাংওয়ালা ঘোড়াই দেখতে পাওয়া যায় না। তা আবার চারটে ঘোড়া এক গাড়িতে। শেষটা ঘোড়ার নালটা দেখে একেবারে থ! এই এত বড়ো নাল হয় কখনো ঘোড়ার? হাতি নয় তো? হাতির পায়ে আমি নাল লাগাতে পারব না গুপি দাদা, এই বলে দিলাম।
আমরা বুঝিয়ে বললাম, চলোনা, গিয়ে নিজের চোখেই দেখবে। এত প্রকাণ্ড ঘোড়াই দেখলে কোথায়, যে এত বড়ো নাল দেখবে? চলো, তোমার লোহাটোহা নিয়ে চলো, ওদের খুব তাড়াতাড়ি আছে, দেরি করলে কার যেন প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে। মেলা কাগজপত্র নিয়ে চলেছেন। চলো। নাও, ধরো, নালটাও তোমার যন্ত্রের বাক্সে রাখো। ভারী আছে।
শম্ভু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। বড়ো ঘোড়া যে হয় না তা বলছি না। ফতেপুর সিক্রি গিয়ে আকবরের ঘোড়ার যে বিরাট নাল দেখে এসেছি, তারপরে আর কী বলি।
কথা বলতে বলতে গলির-মুখে এসে পড়েছি। কিন্তু কোথায় চার ঘোড়ার গাড়ি? চারিদিক চুপচাপ থমথম করছে, পথে ভালো আলো নেই, একটা মানুষ নেই, কুকুর নেই, বেড়াল নেই, কিছু নেই! ডাইনে-বাঁয়ে দু-দিকে যত দূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখলাম কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না।
রাস্তার আলোর কাছে গিয়ে কী মনে করে শম্ভু যন্ত্রপাতির বাক্সটা খুলে নালটা বের করতে গিয়ে দেখে বাক্সের মধ্যে নালও নেই। তখন শম্ভ ফ্যাকাশে মুখে আমাদের দিকে চেয়ে বলল, ও গাড়ি আরও অনেকে দেখেছে, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকে না। ওই রাজা বাহাদুর মহারাজা নন্দকুমারের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু সময়কালে পৌঁছোতে পারেনি। তোমরা তাই দেখেছ। বলে আমাদের একরকম টানতে টানতে ওর বাড়ি নিয়ে গেল। পরদিন সকালে যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম। গুপি আর জাহাজের কথা তুলল না।
সত্যি নয়
গল্পটা গুপির কাছে শোনাঃ
দলের মধ্যে মেলা লোক ছিল– মেজোমামা, ভজাদা, জগদীশবাবু, গুপির সেজদা, গুপি আর শিকারিরা দু-জন। সারাদিন বনেজঙ্গলে পাখিটাখি আর মেলা খরগোশ তাড়িয়ে বেড়িয়ে সন্ধ্যের আগে সকলে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। জমিদারবাবুর ঘোড়াগাড়ি এসে বাজপড়া বট গাছের তলায় অপেক্ষা করে থাকবে, ওঁরা জন্তুজানোয়ার মেরে ক্লান্ত হয়ে গাড়ি চেপে জমিদারবাড়ি যাবেন। সেখানে স্নানটান করে রাতে খুব ভোজ হবে। কিন্তু কী মুশকিল, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পরও যখন গাড়ি এল না, শিকারিরা দু-জন খোঁজ করবার জন্য এগিয়ে গেল। এরা সব গাছতলায় পা মেলে যে-যার পড়ে রইল।
আরও মিনিট কুড়ি গেল, দিব্যি চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, তখন জগদীশবাবু লাফিয়ে উঠে পড়লেন। ওই তোরা, এ জঙ্গলে নিশ্চয়ই বাঘ আছে। খিদের সকলের পেট জ্বলে যাচ্ছে, তার উপর দারুণ পায়ে ব্যথা, কিন্তু ওকথা শুনেই সবাই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। বেশ তারার আলো হয়েছে। তার মধ্যে মনে হল যেন ডান দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলে জঙ্গলটা পাতলা হয়ে এসেছে, সেখানে যেন আলো বেশি। সেদিকে খানিকটা যেতেই সবাই অবাক হয়ে দেখল সামনেই বিশাল একটা পোড়ো বাড়ি।
মেজোমামা তো মহা খুশি। বাঃ, খাসা হল, এবার শুকনো কাঠকুটো জ্বেলে দুপুরের খাবার জন্য যে বড়ো হাঁড়িটা আনা হয়েছিল তাতে করে খরগোশের মাংস রাঁধা যাবে। নিদেন একটু বিশ্রাম তো করা যাবে। সবাই খুশি হয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
গেটটা কবে থেকে ভেঙে ঝুলে রয়েছে, একটু একটু বাতাস দিচ্ছে, তাতে কাচ কোচ শব্দ করছে। বিশ্রী লাগে। পথে সব আগাছা জন্মে গেছে, বাগানটা তো একেবারে সুন্দরবন। প্রকাণ্ড বাড়ি, প্রকাণ্ড বারান্দা। বারান্দার উপর উঠে জগদীশবাবু শ্বেত পাথরের মেজের উপর বেশ করে। পা ঘষে কাদামাটি পরিষ্কার করে ফেললেন। গুপির সেজদা একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে বললে, জায়গাটাকে সেরকম ভালো মনে হচ্ছে না। সেজদার যেমন কথা, ঘোর জঙ্গলের পোডড়া বাড়ি আবার এর থেকে কত ভালো হতে পারে। গুপি আবার বললে, এ বাড়িটার বিষয় আমাদের চাকর হরি একটা অদ্ভুত গল্প বলছিল। এদিকে কেউ আসে না।
একেবারে ভাঙা বাড়ি কিন্তু নয়। দরজাগুলো সব বন্ধ রয়েছে, কেউ বাস করাও একেবারে অসম্ভব নয়। তখন সকলে মিলে মহা হাঁকডাক লাগিয়ে দিলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সকলের যে ঠিক ভয় করছিল তা নয়, কিন্তু কীরকম যেন অস্বস্তি লাগছিল, তাই সব এক জায়গায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেজোমামা বললেন, যা, যা, যেসব বীরপুরুষ, নে চল, দরজা ঠেলে খোল, রাঁধাবাড়ার আয়োজন করা যাক।