সকালে পরদেশি এসে ডেকে দিল, কুট্টিবাবু আঁক শেখাতে এসেছেন। কুটিবাবুও এসে, চিত্র-করা পাটিতে বসে সারাটা সকাল আমাকে অঙ্ক কষালেন। পরদেশি কোনো কথা না বলে দু-জনকে দুই গেলাস দুধ দিয়ে গেল। বই নেই, কিছু নেই, পুঁটলিতে খাতা-পেনসিল ছিল, তাই দেখে কুট্টিবাবু মহাখুশি। কী বলব, যে সব অঙ্ক সারা বছর ধরে বুঝতে পারছিলাম না, সব যেন জলের মতো সোজা হয়ে গেল। কুট্টিবাবুর বই দরকার হয় না, সব মাথার মধ্যে ঠাসা।
উনি চলে গেলে, বারান্দায় বেরিয়ে দিনের আলোতে ভালো করে চেয়ে দেখি এরা সব বাড়িঘর ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফেলেছে। উঠোনের ধারে ধারে বড়ো বড়ো টবে করে কতরকম পাতাবাহারের গাছ, আর উঠোনে দাঁড়ের উপর লাল-নীল-হলদে-সবুজ মস্ত মস্ত তোতা পাখি রোদে বসে ছোলা খাচ্ছে।
দেয়াল ঠেস দিয়ে পরদেশি মুচকি মুচকি হাসছে। কাকে খুঁজছ, খোকাবাবু? বুড়ো লোকটির খোঁজ করলাম। কী তার নাম পরদেশি? বড্ড ভালো লোক। পিছন থেকে তিনি নিজে বললেন, আমার নাম শিবেন্দ্রনারায়ণ, লোকে শিবুবাবু বলে ডাকে। তুমি নাকি ভালো করে অঙ্ক কষেছ, কুট্টি বলছিল। এই নাও তার পুরস্কার। আমার হাতে একটা মস্ত সোনার মোহর গুঁজে দিলেন। ও কী পরদেশি? বাইরের দরজায় কারা যেন মহা ধাক্কাধাক্কি চেঁচামেচি করছে। সঙেরা নয় পরদেশি? পরদেশি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল, আমি বললাম, এই রে, তবে নিশ্চয় বাবা এসেছেন আমাকে খুঁজতে। ছুটে নীচে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। মা, বাবা, বড়োকাকা আর পিসেমশাই এসেছেন। ইশ, কী সাংঘাতিক ছেলে বাপু তুমি। এই খালি বাড়িতে অন্ধকারে, কালিঝুলের মধ্যে, খাওয়া নেই দাওয়া নেই দিব্যি রাত কাটিয়ে দিলে? বলিহারি তোমাকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি এক মুহূর্তের মধ্যে পরিষ্কার তকতকে উঠোন, তোতা পাখির সারি, পাতাবাহারের গাছ, সব উড়ে গেছে। পাগলের মতো দৌড়ে উপরে উঠলাম, খালি ঘর খাঁ খাঁ করছে, ভাঙা স্নানের ঘরে শ্বেত পাথরের সব টালি খুলে পড়ে আছে। পরদেশি, ও পরদেশি, শিবুবাবু, কোথায় তোমরা?
বাবা আমাকে খপ করে ধরে ফেললেন, জানিস না, শিবুবাবু আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, পরদেশি তার খাস খানসামা।
আস্তে আস্তে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে মোহরটাকে পকেটে পুরে বললাম, চলো, টেস্টে আমি অঙ্কে ভালো নম্বর পাব, দেখো। কাউকে কিছু বলতে পারলাম না।
আমি ঠিক করেছি বড়ো হয়ে টাকাপয়সা রোজগার করে আহিরিটোলার বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে সেখানেই থাকব। গঙ্গাটাও বেশ সামনে আছে।
কী বুদ্ধি
জন্তুজানোয়ারদের বিষয়ে কতরকম অদ্ভুত গল্পই যে শোনা যায় তার আর ঠিক নেই। একবার নাকি একটি ব্যাঙ কেমন করে পাথরের ফোকরের মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়ে, ওইভাবে কতকাল যে ছিল তার ঠিক নেই। বোধ হয় অনেক-শো বছর। তারপর যেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হল, অমনি সে চাঙা হয়ে উঠে বার দুই চোখ মিটমিট করে, থপ থপ করে কোথায় চলে গেল, যেন কিছুই হয়নি।
তারপর আরেকটা অদ্ভুত গল্প শুনেছিলাম, গোবি মরুভূমিতে কয়েক জন ভূপর্যটক নাকি বিরাট বিরাট গোল গোল পাথরের মতো কী পেয়েছিলেন, সেগুলি ভেঙে দেখেন কোন অতিকায় জানোয়ারের ডিম। বালির মধ্যে থেকে ভিতরটা একটুও নষ্ট হয়নি।
এসব গল্পের সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে অবশ্য আমি কিছুই বলতে চাই না, তবে চেনাজানা জানোয়ারের মধ্যে, একবার একজন বাঘ-শিকারির কাছে একটি মজার বাঁদরের গল্প শুনেছিলাম। তার নাম মুকুন্দবাবু, তিনি তো বলেছিলেন গল্পটা সত্যি।
একবার নাকি তারা তোকজন নিয়ে মধ্য ভারতের কালাহান্দির ঘোর জঙ্গলে বাঘ শিকারে গেছেন। গভীর বনের মধ্যে তাঁবু গেড়েছেন। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে অবধি কানে আসছে একটা অনর্গল গুনগুন শব্দ। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখেন, বিরাট এক বোলতার চাক, লম্বা হয়ে নীচু একটা গাছের ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে। হাজার হাজার বোলতা যাওয়া-আসা করছে, আর গুনগুন শব্দ হচ্ছে।
তাবুর সামনে বসে মুকুন্দবাবু মজা দেখছেন। চাক থেকে নীচে মাটির উপর টুপটুপ করে মধু পড়ছে, প্রজাপতিরা উড়ছে, পাখিরা কিচিরমিচির করছে। এমনি সময় চোখ পিটিরপিটির করতে করতে এক বাঁদরছানা এসে হাজির। ছোঁক ছোঁক করতে করতে একেবারে চাকের তলায় গিয়ে উপস্থিত।
চাকটা খুব নীচু ডালে ঝুলছে, বাঁদরছানা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাই দেখল। তারপর আঙুল দিয়ে মাটি থেকে একটু মধু তুলে নিয়ে চেটে খেল।
ইস্! কী ভালো রে! আরেকটু পেলে হয়।
এই ভেবে বাঁদরছানা চাকটাকে একটু ঠেলেঠুলে দেখতে লাগল। হয়তো-বা একটা বোলতাকে চিপে দিয়ে থাকবে, কী যে কারণেই হোক, কোত্থেকে এক বোলতা এসে দিয়েছে হুল ফুটিয়ে। আরে বাপ! আর যায় কোথা! ওই ছোটো বাঁদরছানা মানুষের মতো হাত ঝেড়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, সাংঘাতিক কাঁও ম্যাও করে, জঙ্গলটাকে একেবারে মাতিয়ে তুলল। তারপর চাচাতে চাচাতে দৌড়াতে দৌড়োতে সে তো সেখান থেকে ভাগল।
কিন্তু একটু বাদেই, ও মা, কোত্থেকে এক ধাড়ি বাঁদরকে সঙ্গে এনে হাজির! চাকের কাছে এসে কিচিরমিচির হুকুহুকু করে কী যে না বলল তার ঠিক নেই।
তারপর ছানা বাঁদর তফাতে দাঁড়িয়ে রইল, ধাড়ি বাঁদর খুব সাবধানে গুঁড়ি মেরে চাকের কাছে এসে উপস্থিত হল। ততক্ষণে বেলা একটু বেড়েছে, বোলতারা বেশিরভাগই চাকের মধ্যে ঢুকেছে, মাঝে মাঝে একটা একটা বেরুচ্ছে, আর উড়ে চলে যাচ্ছে।