লণ্ঠন হাতে বারান্ডা থেকে হলে ঢুকলেন। নীচের তলাটা বরং ভালো, একটা তক্তপোশে বসে বসেই রাত কাটানো যাবে। পকেট চাপড়ে দেখলেন অশরীরী-খুনে লোমহর্ষণ ১০নং খানা দিয়ে দিতে জগুর বাবা ভোলেননি। রাত জেগে ওইটি পড়ে শেষ করে, কাল সকালে আগাগোড়া গল্পখানি বলতে হবে। তবে বাজি জেতা।
পা টিপে টিপে হল পার হয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সদর দরজার ডান পাশের ঘরখানিতে ঢুকে, ভাঙা সিন্দুকের উপর লণ্ঠন নামিয়ে, তক্তপোশের কোণটা ধুতির খোঁট দিয়ে ঝেড়ে, ধপ করে পিসেমশাই বসে পড়লেন। ময়লা খোঁটটা দিয়েই গলার, কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। আঃ, বাঁচা গেল। ভাগ্যিস ভূতে বিশ্বাস করেন না। নইলে তো আজ ভয়েই আধমরা হয়ে যেতে হত।
সামনের রংচটা আয়নাতে একখানি সাদা ছায়া পড়ল। বুড়ো লোকটি ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে, অনুনয়ের স্বরে বললেন– দিয়েই দে-না বাবা। তোর আর কী কাজে লাগবে বল? যারা দেয় তারা প্রাণ হাতে করে এনে দেয়। না পেলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যায়। কেন দিচ্ছিস না, বাপ? একে একে সবই তো প্রায় নিয়েছিস, আরও চাস বুঝি? তোর প্রাণে কি মায়াদয়াও নেই? প্রথম যখন এলি, কী ভালো মানুষটিই ছিলি? আমি উপরের ওই নীল গালচেটাতে বসে সেতার বাজাতাম, আর তুই বারান্ডায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে শুনতিস। তোকে কতনা ভালোবাসতাম, এটা-ওটা রোজই দিতাম, কত-না ভালোমানুষ সেজে নিতি। ভেতরে ভেতরে তুই যে এত বড়ো একটা বিশ্বাসঘাতক কেউটে সাপ তা কি আর জানি।
মেজো পিসেমশাই লাফিয়ে উঠে এক হাত সরে দাঁড়ালেন। বুড়ো লোকটিও খানিকটা এগিয়ে এলেন, রাগে তার দু-চোখ লাল হয়ে গেল, ফর্সা দুটো মুঠো পাকিয়ে মেজো পিসেমশাইয়ের নাকের কাছে ঘুসি তুলে বললেন, একদিন এই ঘুসিকে দেশসুদ্ধ লোকে ভয় করত, কোম্পানির সাহেবরা এসে এর ভয়ে পা চাটত। এখন বুড়ো হয়ে গেছি, দুর্বল হয়ে গেছি, তাই আমার বাড়িতে আমার মাইনে-খাওয়া চাকর হয়ে, তোর এত বড়ো আস্পর্ধা। তবে এখনও মরিনি, এখনও তোকে এক মুঠো ভস্মে না রে না, কী বাজে কথা বলছি। দিয়ে দে বাবা, দেখ তোকে তার বদলে কী দেব।
এই বলে বুড়ো লোকটি আঙুল থেকে হিরের আংটিখানি খুলে মেজো পিসেমশাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মরিয়া হয়ে পিসেমশাই ইদিক-ঊদিক তাকালেন। কী যে দেবেন ভেবে না পেয়ে, পকেটে হাত দিতেই গোলাপি বিড়ির প্যাকেট দুটোর উপরে হাত পড়ল। তাই বের করে বুড়োর হাতে দিয়ে দিলেন।
সত্যি দিলি? আঃ, বাঁচালি বাবা। এই নে, আমি আশীর্বাদ করছি তোর এক-শো বছর পরমায়ু হবে।
এই বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, মেজো পিসেমশাইয়ের বুকপকেটে আংটি ফেলে দিয়ে হলের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ির দিকে দে ছুট। পিসেমশাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। সিঁড়ির প্রথম ধাপটা অবধি তাকে লণ্ঠনের ক্ষীণালোকে দেখতে পেলেন, তারপর সে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। আর পিসেমশাইও তক্ষুনি আরে বাপ বলে মূৰ্ছা গেলেন।
পরদিন সকালে জগুর বাবা, পটলের মামা, আমার বাবা, আরও পাঁচ-সাত জনা গিয়ে ঠ্যাং ধরে টেনে পিসেমশাইয়ের ঘুম ভাঙালেন। উঠে দেখেন ঘরদোর রোদে ভরে গেছে। তারা বললেন– উপরে গেছলি? তবে দে, উপরের বর্ণনা দে।
ঠিক বলছেন কি না পরখ করবার জন্য সবাই মিলে উপরে গেলেন। পিসেমশাইও গেলেন। সব ঘরদোর শূন্য হাঁ হাঁ করছে। জগুর বাবা তো রেগে টং। ইস, অত ভালো ছাগলছানা হাতছাড়া হয়ে গেল। ইস, ক্লাবের রাক্ষসগুলোকে তার উপরে বাজির খাওয়া খাওয়াতে হবে।
মাটিতে অশরীরী-খুনে পড়ে ছিল।
আঁ! ঠিক হয়েছে। বড়ো যে ঘুমুচ্ছিলি, বইটা পড়েছিলি? বল তবে, আগাগোড়া গল্পটা বল। মেজো পিসেমশাইয়ের মুখে আর কথাটি নেই। মনে মনে দেখতে পেলেন জগুর বাবা সোনালি ছাগলটাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। সারারাত ঘুম লাগিয়েছেন, স্বপ্ন দেখেছেন, তার উপযুক্ত সাজা তো হবেই।
লজ্জায়, দুঃখে, মাথা নীচু করতেই চোখ পড়ল বুকপকেটের ভিতর হিরের আংটি জ্বলজ্বল করছে। মেজো পিসেমশাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বললেন– নিয়ে যা তোর ছাগল। ইস, ভারি তো ছাগল। বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোজা বাড়িমুখো রওনা দিলেন।
মেজোমামার প্রতিশোধ
আমার মেজোমামাকে নিশ্চয় তোমরা কেউ দেখনি। হাড় জিরজিরে রোগা বেঁটেমতন, সরু লিকলিকে হাত পা; সারা মুখময় খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। কারণ মেজোমামা দু-সপ্তাহে একবার দাড়ি চাচেন, নাকি দাড়ি কামালেই মুখময় আঁচড়ে যায়; খাটো করে ধুতি পরা, আর প্রাণ ভরে নানা রকমের ভয়, চোরের ভয়, পুলিশের ভয়, বাঘের ভয়, গাড়ি চাপা পড়ার ভয়, রোগের ভয়, ডাক্তারের ভয়, ভূতের ভয়, আর সবচেয়ে বেশি ভয় নিজের শ্বশুরকে।
মেজোমামার শালার বিয়ে হবে। শ্বশুর লিখে পাঠালেন মেজোমামাকে নিজে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে শ্বশুরের ঠাকুরমার আমলের লাখ টাকার গয়না বের করে নিয়ে নৈহাটি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। খুব সাবধানে যাওয়া-আসা করতে হবে কারণ ও-জিনিস একবার গেলে আর হবে নাঃ আর দুষ্টলোকে খবর পেলে ওর জন্য মারপিট খুনজখম করতে পিছুপাও হবে না। শুনে তো মেজোমামার জিভতালু জড়িয়ে গেল, অথচ না গেলেও নয়, শ্বশুর তাহলে আর আস্ত রাখবেন না।
বঙ্কুদাদার গাড়িটা চেয়ে নিয়ে একেবারে স্টেশন যাবার পথে গয়নার বাক্স বের করে নিয়ে একটা আধময়লা বাজারের থলিতে পুরে, তার উপর কতকগুলো মুলোটুলো দিয়ে যত্ন করে ঢাকা চাপা দিয়ে তো স্টেশনে নামা গেল। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চির একটি কোনা দখল করতেও বেশি সময় লাগল না। এতক্ষণে মেজোমামা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। থলিটাকে বেঞ্চির কোণে গুঁজে তার উপর একরকম চেপে বসে ওফ করে এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ধুতির খুঁটটা দিয়ে কপালের গলার ঘামটাম মুছে নিলেন। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পাশে বসে পড়ল। উঃ, যেন সাক্ষাৎ করাক্ষস, ইয়া ছাতি, ইয়া হুঁড়ি আর ইয়া বড়ো বড়ো পান-খাওয়া বত্রিশপাটি দাঁত। তাকে দেখেই মেজোমামার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কী অসৎ চেহারা লোকটার সে আর কী বলব। কানের লতি টানা, নাকের ফুটো বড়ো, চোখ ছোটো, জোড়া ভুরু, আঙুলের গিঁটে গিঁটে লোম।