সত্যি সত্যি বলতে কী, অন্ধকারে দেখতে পাবার আমারও যথেষ্ট ইচ্ছে ছিল। গুপির কাছ থেকে কাগজটি নিয়ে আরেক বার পড়লাম। একটু অদ্ভুত যে, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। বললাম, আচ্ছা, অন্ধকারে দেখতে পাওয়া মানেই তো অন্ধকারে আমাদের চোখও জ্বলজ্বল করবে? তার কিন্তু মেলা অসুবিধেও আছে।
–আছেই তো। তাইজন্যে যদি ভয় পেয়ে যাস তাহলে আর তোর এর মধ্যে এসে কাজ নেই। ভীতুদের কম্ম এ নয়। মেঘলার কাছে শুনেছি, ওর দাদামশাই মেলা মন্ত্রতন্ত্র জানত। যেমন, মানুষকে ছাগল করা, ছাগলকে মানুষ করা, এমনি ধারা কত কী। শুধু বড়িটা গিলে ফেললেই হল না, অত সহজে হলেই হয়েছিল আর কী। নীচে যেসব লেখা আছে তার কোনো মানে বুঝতে পারলি নাকি?
মনে হল হয়তো সংকেতে লেখা হবেও-বা। কীসব সংখ্যা-টংখ্যা দেওয়া, গোড়াটা এই ধরনের– ৩ উ ১ জো সো ১ সো ১ সো ২ উ মাঝে মাঝে তারা চিহ্ন দেয়া। শুনেছি লন্ডনের বিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেও এইসব গোপন সংকেত পড়বার জন্য মাইনে-করা লোক থাকে। তবু এক বার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী। তা বড়িটা গুপে কিছুতেই দেবে না। শেষপর্যন্ত বড়ি রইল ওর কাছে, কাগজ থেকে লেখাটুকু টুকে নিলাম।
গুপি বার বার আমাকে সাবধান করে দিতে লাগল। যা তা একটা কিছু করে বসিসনে যেন। মেঘলার কাছে শুনেছি, ওরই এক মামা এক সাধুর সঙ্গে ভাব করে অন্ধকারে দেখার ওষুধ নিয়েছিল, কিন্তু পয়সা না দিয়েই পালিয়েছিল। তারপর থেকে মামা নিখোঁজ কিন্তু ওদের বাড়ির চারপাশে রোজ রাতে একটা বিরাট পাচাকে উড়ে বেড়াতে দেখা যেত। বড়িটা তাই আমার কাছেই রাখলুম।
অনেক মাথা ঘামালাম লেখাটা নিয়ে। আমার পিসতুতো ভাই মাকুদা কবিতা-টবিতা লেখে, তাই নিয়ে প্রায়ই বকুনি-টকুনিও খায়, ওর কাছে বুদ্ধি নিতে গেলাম। অবিশ্যি বড়ি ইত্যাদির কথা একেবারে চেপে গেলাম। বললাম, এগুলি একটা ওষুধের অনুপান, কিন্তু সংকেতে লেখা।
মাকুদা খুব মাথাটাথা নেড়ে খানিক ভেবে বলল, এ তো খুব সোজা, দে তো একটু কাগজ পেনসিল! তারপর কাগজে লিখল তিনটে উট, এক জোড়া সোনার চেন, একটা সোডা ওয়াটার, দুটো উল্লুক এইসব লাগবে আর কী। তারপর পেনসিলটা পকেটে পুরে মাকুদা উঠে পড়ে বলল, ওই পেনসিলটা নাকি ওর। অনেকদিন থেকে পাচ্ছে না। অথচ আমি দস্তুরমতো বসবার ঘর থেকে ওটাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। থাক গে। যখন অন্ধকারে চোখে দেখতে পাব, তখন তো আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
ওই লেখা নিয়ে গুপির সঙ্গে খুব একচোট তর্কাতর্কিও হয়ে গেল। ওর এক বন্ধু আছে, ন্যাপলা, মাথাভরা তেল চুকচুকে কোঁকড়া চুল, এমনি একটা গায়ে-পড়া ভাব যে, দেখলেই পিত্তি জ্বলে যায়। আর গুপির তো সে দিনরাত দস্তুরমতো খোশামুদিই করে; তাই দেখে গুপি আবার ওকে একেবারে মাথায় তোলে। ওকে নিয়ে এর আগেও গুপির সঙ্গে আমার অনেকবার হয়ে গেছে। সেদিনও একচোট হল।
গুপি আর লোক পায়নি, তাকে দিয়ে লেখাটা পড়িয়েছে। তার নাকি ভারি বুদ্ধি, নাকি পাশা খেলায় বড়োদের হারিয়ে দেয়। সে লেখা দেখে বলেছে, ওর মানে তিন ফোঁটা উদক মানে জল, এক জোড়া সোনপাপড়ি, একদানা সোহাগা, আরও দু-ফোঁটা উদক দিয়ে গুলে খেয়ে ফেলতে হবে। বুদ্ধিখানা দেখলে একবার। অথচ গুপি গলে জল। ও-রকম বুদ্ধি নাকি কারো হয় না। বেশ একটা রাগারাগির পরে ঠিক হল এখন কিছু করা নয়, এক্ষুনি স্যার এসে যাবেন বরং সন্ধ্যে বেলা গুপিদের পেয়ারাতলায় যা হবার হবে।
সন্ধ্যে বেলায় গিয়ে দেখি পেয়ারাতলা ভোঁ ভোঁ! জায়গাটা দস্তুরমতো নির্জন, পুরোনো কালের বাগান, ঝোঁপঝাপে ভরতি। দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘনিয়ে এল, দূর থেকে রাস্তার শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম, আবার কাছ থেকে বাগানের মধ্যেও নানারকম অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল। কে যেন সাবধানে হেঁটে বেড়াচ্ছে, লুকিয়ে থেকে কীসে যেন নিশ্বাস চাপতে চেষ্টা কচ্ছে। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।
ভয়ে ভয়ে ইদিক-উদিক তাকাতে লাগলাম। গুপির কিছু হয়টয়নি তো? গুপিই কিছু হয়নি তো? ওর কাছে তো লেখাটাও ছিল, বড়িও ছিল। যদি ওই ন্যাপলাটার বুদ্ধি নিয়ে বড়ি গিলে বসে থাকে।
হঠাৎ আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। চেয়ে দেখি দূরে রঙিন ঝোঁপের মধ্যে থেকে এক জোড়া সবুজ চোখ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। মাটি থেকে দু-হাত উঁচুতে হবে। কী আর বলব, হাত-পা পেটে সেঁদিয়ে গেল। যাই হোক, গুপির যতই দোষ থাকুক, পুরোনো বন্ধু তো বটে! কিন্তু সবুজ চোখ দুটোতে মনে হল কেমন একটা খিদে খিদে ভাব! গুপিই হয়তো ঝোঁপের মধ্যে থাবা গেড়ে বসে আছে, আমি একটু নড়লেই হালুম করে–
আর দাঁড়ালাম না। যা থাকে কপালে, পড়িমরি করে ছুট লাগালাম। একেবারে বাড়িতে এসে থামলাম। সেখানেও কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়? এ বাড়ি তো ওর চেনা, শুকতে শুকতে যদি এসে হাজির হয়? জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে হয়তো-বা স্বচ্ছন্দে গলে যাবে।
আস্তে আস্তে জানলাটা বন্ধ করে দিলাম। সবে একটু বসেছি, দরজার বাইরে কীসের শব্দ! ছুটে গিয়ে দরজাটাকে ঠুসে ধরলাম।
বাবা জোর করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বললেন, সন্ধ্যে বেলা তোরা লাগিয়েছিস কী? ওদিকে গুপিদের ওখানে এক কাণ্ড।
ভয়ে ভয়ে বললাম, বেঁধে রেখেছে?
বাবা তো অবাক! বেঁধে রেখেছে কী! সে বিরাট এক বাদশাহি জোলাপের বড়ি কীসব দিয়ে খেয়ে একেবারে কুপোকাত! এখন আর নড়বার-চড়বার জো নেই। ওটা নাকি ওর মামাবাড়ির কে এক নাপিত মজা করবার জন্য দিয়েছিল। যে-কাগজে মুড়ে দিয়েছিল, তাতে কী একটা উল বোনার প্যাটার্ন লেখা ছিল। কাকে দিয়ে পড়িয়েছে সেটাকে, কী বলতে কী বলেছে সে, সোহাগা-টোহাগা দিয়ে বড়ি খেয়ে বাছাধন সারা বিকেল ছুটোছুটি। এখন ডাক্তার এসে ঘুমপাড়ানি ওষুধ দিয়েছে। কী, শুয়ে পড়েছিস যে? তোরও কি শরীর খারাপ নাকি!