মামিমা কী আর করেন, দিলেন দুটো টাকা; মামা রেগে যাবেন, বলাও যায় না সব কথা। যাবার সময় বহুরূপী মামার মামিমার পায়ের ধুলো নিয়ে, গুপে আর ভোদার দিকে ফিরে এক বার চোখটা টিপল। পরে আমরা শুনলাম নেংটি-পরা লোকটা, চা খেয়ে জিরিয়ে জুরিয়ে, ঠাকুরের কাছ থেকে পান খাবার জন্য চার আনা চেয়ে কখন গুটিগুটি কেটে পড়েছে। মামিমা বললেন চেপে যেতে। আজ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না।
বাঘের চোখ
অঙ্কের ক্লাসে আমার বন্ধু গুপির সব অঙ্ক ভুল হল। আর সেসব কী সাংঘাতিক ভুল তা ভাবা যায় না। বাঁশ গাছের অঙ্কটার আসল উত্তর হল পঁচিশ মিনিট, গুপির হয়েছিল সাড়ে পাঁচটা বাঁদর। অমলবাবু তাই নিয়ে ওকে যা নয় তাই সব বললেন-টললেন। গুপি শুধু অন্যমনস্কভাবে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
টিফিনের সময় আমাকে বলল, এই, ঝাল মটর খাবি? আমি একটু অবাক হচ্ছি দেখে কাষ্ঠ হেসে বলল, দ্যাখ, আসল জিনিসের সন্ধান পেয়ে গেছি। ওসব তুচ্ছ কথায় আমার আর কিছু এসে যায় না।
এই বলে পকেট থেকে কাগজে-মোড়া একটা ছোট্ট জিনিস বের করল। পুরু ময়লা কাগজে মোড়া, রাংতা দিয়ে জড়ানো একটা গুলি মতন। বললে, কী, দেখছিস কী? কাগজটা একবার পড়ে দ্যাখ।
লাল কালি দিয়ে খুব খারাপ হাতের লেখা। অনেক কষ্টে পড়লাম, অন্ধকারে চোখে দেখার অব্যর্থ প্রকরণ। তারপর গিজিগিজি করে আরও কত যে কী লেখা তার মাথামুণ্ডু বুঝে উঠলাম না।
গুপি গুলিটাকে আবার কাগজে মুড়ে যত্ন করে বুকপকেটে রাখল। বললাম, কী ওটা?
–কী ওটা! চট করে কি আর বলা যায়? তবে সম্ভবত বাঘের চোখের মণি।
–সেকী! তোমার-না বেড়াল দেখলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে, ওয়াক আসে, বাঘের চোখের মণি দিয়ে তুমি কী করবে?
গুপি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললে, কাকে কী যে বলি! আরে, অন্ধকারে চোখে দেখবার গুণ পাওয়াটা কি যে-সে কথা? পারে সবাই ইচ্ছেমতো জন্তু-জানোয়ার হয়ে যেতে?
আমি তো অবাক। আমার ছোড়দাদু কানের মধ্যে কীসব গান-বাজনা ঝগড়াঝাটি শুনতে পেতেন, তারপর অনেক ওষুধ-টষুধ করে তবে সারল; এও সেই নাকি?
গুপে রেগে গেল। বললে, শোন তবে। বড়োদিনের ছুটিতে মামাবাড়ি গেছলুম জানিস তো? প্রত্যেক বছর শীতকালে মামাবাড়ির সামনের মাঠে তিন দিন ধরে মেলা বসে। সে কী বিরাট মেলা রে বাপ! দেখলে তোর মুণ্ডু ঘুরে যেত। কী থাকে না ওই মেলায়, সিনেমা, সার্কাস, হিমালয়ের দৃশ্যের সামনে চার আনা দিয়ে ফোটো তোলা, দুমুখো সাপ, যাত্রাগান, কুস্তির আখড়া, বাউল নাচ, দোকানপাট, তেলেভাজা, হাত-দেখানো গণক-ঠাকুর কিছু বাকি থাকে না।
পাড়ার লোকে সাতদিন দু-চোখের পাতা এক করতে পারে না। দু-দিন আগে থাকতে গোরুগাড়ির কাচকোঁচ, গাড়োয়ানদের ঝগড়া, ভিজে ঘুঁটের ধোঁয়া, আর অষ্টপ্রহর ছাউনি তোলার ঠুকঠাক। মেলার তিনদিন তো গান-বাজনা হই-হল্লোড়ে কারো ঘুমুতে ইচ্ছেও করে না। তারপর দু-দিন ধরে ভাঙা হাটে সস্তা দরে জিনিস কেনার সে কী হট্টগোল।
তারপর যে-যার গোরুগাড়ি বোঝাই করে চলে যায়। মাঠের মধ্যে পড়ে থাকে কতকগুলো উনুন তৈরির পোড়া পাথর, খুঁটি পোঁতার গর্ত, ভাঙা খুরি আর ছেঁড়া চাটাই। কয়েকটি ময়লা কাগজের টুকরো আর শাল পাতার ঠোঙা বাতাসে উড়ে উড়ে পড়তে থাকে। যত রাজ্যের নেড়ি কুত্তোরা এসে কীসব খুঁজে বেড়ায়। হঠাৎ যেন শীতটাও কীরকম কেঁপে আসে। সে একবার ওখানে ওই সময় না থাকলে তুই বুঝবিনে।
তবে যারা মনে করে, মেলা উঠে গেলেই মাঠে আর কিছু বাকি থাকে না, তারা যে কিছু জানে না এই কাগজে মোড়া জিনিসটাই তার প্রমাণ।
এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলুম। বললুম, ও, তুই বুঝি ওটাকে ওই মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছিলি, তাই বল। তা এখন ওটাকে নিয়ে কী করতে হবে শুনি?
গুপি উঠে পড়ে বলল, ও! টিটকিরি হচ্ছে বুঝি? থাক তবে। বলে সত্যি সত্যি ক্লাসে ফিরে গেল।
পরদিন ছিল শিবরাত্রির হাফ হলিডে। ধরলাম ওকে চেপে, না রে গুপি, গুলিটার কথা বলতেই হবে। দুজনে মিলে ওর একটা হিল্লে করে নিতে পারব।
আসলে গুপিও তাই চায়। বললে, বলিনি তোকে আমার মামাবাড়ির নাপিত মেঘলার কথা? রোগা সুটকো কুচকুচে কালো মাথায় একটাও চুল পাকেনি, তিরের মতো সোজা, এক-শো হাত দূরে থেকে গাছের ওপর নাকি শকুনের চোখ দেখতে পায়; একদিনে পনেরো মাইল হেঁটে ওর গাঁয়ে গিয়ে আবার সেই দিনই ফিরে আসাকে কিছু মনে করে না। ওদিকে ও আবার দাদামশাইয়ের বাবারও দাড়ি কামাত। বয়সটা তা হলে ভেবে দ্যাখ।
তার সঙ্গে নাকি শ্যামদেশে গেছল, সেখানে গভীর বনের মধ্যে কে এক ফুঙ্গি ওকে জলপড়া করে দিয়েছিল, সেই থেকে নাকি ওর শরীর একটুও টসকায় না। গুম-গুম করে নিজের বুকে কিল মেরে বলে, তোরাই বল, কোন জোয়ানের শরীরে এর চেয়ে বেশি জোর। ওই মেঘলাই এই বড়িটাকে কুড়িয়ে পেয়ে আমাকে দিয়েছে।
আমি বললুম, কেন, তোকে দিলে কেন? তুই কিছু করবি ভেবেছে নাকি মেঘলা?
গুপি খানিক চুপ করে বলল, আসল কথা কী জানিস, মেঘলা লিখতে পড়তে জানে না; বড়িটা আসলে কী ব্যাপার বুঝেই ওঠেনি। নইলে কি আর অমনি অমনি দিয়ে দিত ভেবেছিস নাকি। ভীষণ চালাক ওই মেঘলা, বললে, দু-মুখো সাপের ঘরের সামনেটাতে কুড়িয়ে পেয়েছে। বোধ হয় ফেলেই দিচ্ছিল। আমি কাগজটার ওপর একটু চোখ বুলিয়ে, আর কি ওকে হাতছাড়া করি। তখন ব্যাটা আমার কাছ থেকে পঁচিশ নয়া পয়সা নিয়ে, তবে-না আমাকে দিল।