তার আগের বছর ওই বনে আগুন লেগেছিল, তিন দিন ধরে কেউ নেভাতে পারেনি। মাথার ওপর আকাশটা রাঙা হয়েছিল। বাতাসের সঙ্গে ছাই উড়ে এসে ডোরাকের বাড়ির দাওয়াতে পড়ছিল। আগুনের আঁচ পেয়ে ডোরাকের গোরু-ছাগল পাগলের মতো হয়ে উঠেছিল। তাদের আর কিছুতেই বেঁধে রাখা গেল না। প্রথমটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁপতে থাকল, তারপর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, খুঁটি উপড়ে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। ডোরাকের বউ বলছিল, কাছে পিঠে আগুন লাগলে জন্তু-জানোয়ার বেঁধে রাখতে হয় না।
খুব কাছে আসতে পারেনি আগুন। পাড়ার সবাই মিলে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে আগুন ঠেকিয়েছিল। ডোরাক এত ক্লান্ত হয়ে গেছিল যে, ঘুরে ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। দিক ঠাওর করতে পারছিল না। হঠাৎ দেখে বনের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা। হয়তো অন্য বছরের আগুনে অনেক গাছ পুড়ে গেছিল সেখানকার, তাদের জায়গায় চারাগাছ কয়েকটা বেরিয়েছিল, তবে চারা তেমন বাড়েনি।
খানিকটা দম নেবার জন্য ডোরাক সেখানে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর একটু বসেছিল। এমনি সময় হুড়মুড় করে বন থেকে অনেকগুলি জানোয়ার বেরিয়ে এল। তার মধ্যে একটা কালো ভালুকও ছিল, তার বুকে একটা ছানা।
খোলা জায়গায় এসে তারা থমকে দাঁড়াল, তারপর হয়তো মানুষ দেখেই যে যেদিকে পারে ছুটে পালাল। দিনের আলো কমে এসেছে, ডোরাক তাদের ভালো করে নজর করতে পারল না। কিন্তু মা ভালুটা সামনে পড়ে গেছিল, সে একেবারে পাথর বনে গেল। ছানাটা অমনি কুঁই কুঁই করে উঠল, ভালুক হঠাৎ চমকে উঠে তাকে ফেলে, নিমেষের মধ্যে কীরকম একটা চিৎকার করে, আবার জ্বলন্ত বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কোথায় গেল তার নিজের ছানা?
ডোরাক অবাক হয়ে দেখল, এটা ভালুকছানা নয়। নিদারুণ ভয়ে ভালুকটা ভুল করে আর কারো ছানা তুলে নিয়ে এসেছে। কুকুরছানার মতো শুঁকে শুঁকে বাচ্চাটা একেবারে ডোরাকের কোলের কাছে এসে হাজির।
ডোরাক তাকে বুকে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। তার বুক, পেট, পায়ের ভেতর দিকটা নরম সাদা রোয়ায় ঢাকা, ওপরটা ফিকে হলুদ, তাতে মিহি একটু কালোর ছোপ ছোপ লেগে রয়েছে, মাথাটা গায়ের তুলনায় যেন একটু বড়ো মনে হল।
চিতা বাঘের ছানা। দু-পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডোরাকের হাঁটু চাটে। দুধ ছাড়া কিছু খায় না। ডোরাকের বউ কোলে নিলে তার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে বোধ হয় মাকে খোঁজে। বউয়ের মনটা কেমন করে। রাতে ডোরাকের কম্বলের তলায় ঢুকে ছানাটা ঘুমোয়।
তিন মাস ছিল ছানাটা। বেশ বড়ো হয়ে উঠেছিল, সারা গায়ে মোলায়েম কালো চাকা চাকা দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটেছিল। বাড়িময় একটা বাঘ বাঘ গন্ধ লেগে থাকত। বাইরের কুকুররা আর ভেতরে এসে জ্বালাতন করত না।
ছানাটাকে ওরা নিরামিষ খাওয়াত, দুধ, ভাত, ডাল, তরকারি। পাকা কলা খেতে ভারি ভালোবাসত। টক দইয়ের সঙ্গে পাকা কলা মেখে দিলে চেটেপুটে খেয়ে, ল্যাজ নেড়ে-টেড়ে একাকার করত।
বউয়ের বাবার নব্বই বছর বয়স, লাঠি ভর দিয়ে পাহাড়ময় টুকটুক করে ঘুরে বেড়াত। সে বলত, বাঘ পোষা যে সে কম্ম নয়। খবরদার যেন, রক্তের স্বাদ না পায়; শিরার ভেতরকার ঘুমোনো আগুন যেন জ্বলে না ওঠে।
এমনিধারা কথা বলত বুড়ো। আর ছানাটা উনুনের পাশে শুয়ে শুয়ে ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকত। হলদে চোখের পেছনে মনে হত কে যেন বাতি জ্বেলেছে। কিছু বলত না কাকেও। মুরগিছানাগুলো ওকে একটুও ভয় পেত না, ওর পিঠে চড়ত।
ততদিনে শীত কেটে গেছে। চারদিকের পাহাড়গুলো সবুজ হয়ে উঠেছে। ন্যাড়া গাছে পাতার কুঁড়ি সব খুলে গেছে। রোদ ঝিকমিক করছে। সর্বজয়া গাছে কলি ধরেছে। দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস দিচ্ছে। প্রজাপতিরা উড়ছে।
সারা সকাল ছানাটা বনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকত। দুপুরে দই-ভাত না খেয়ে, কালো মুরগিটাকে ধরে সকলের চোখের সামনে কড়মড় করে খেয়ে ফেলল। কেউ বাধা দেবার আগেই কম্ম শেষ।
ডোরাকের বউ কেঁদেকেটে সারা; ওর মানতকরা কালো মুরগি, বাড়িতে এবার অকল্যাণ হবে। রাগ করে শেকল দিয়ে ছানাটাকে বেঁধে রাখল। রাতেও তাকে ঘরে তুলল না। শুল না সারাদিন ছানাটা, খালি বনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল। পরদিন সকালে দোর খুলে বউ দেখে রাতে কখন শেকল ছিঁড়ে সে পালিয়ে গেছে।
ডোরাকের কাছে গিয়ে বউ কেঁদে পড়ল, যেমন করে পার, আবার ধরে আনো, আমি ওকে বেঁধে রাখব, মাংস খেতে দেব।
ডোরাক শুধু মাথা নাড়ল।
বউয়ের বুড়ো বাবা বলল, আমাদের জঙ্গল-দপ্তরের দরজার ওপর লেখা আছে, বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায়, কিন্তু জানোয়ারের মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না।
বহুরূপী
ছোটোবেলাকার কত কথাই যে মনে পড়ে, কত কাণ্ডই যে তখন হত। একবার গুপের মামাতো ভাই ভোঁদা বলেছিল যে বহুরূপীরা পর পর সাত দিন আসে, এক-এক দিন এক-এক নতুন সাজে। কখনো কখনো সবাই তাকে বহুরূপী বলে চিনে ফেলে, আবার কখনো কখনো সে এমনি চেহারা বানিয়ে আসে যে কেউ তাকে বহুরূপী বলে টেরই পায় না। তারপর একদিন নিজের সত্যিকার চেহারা নিয়ে এসে, যে যা কিছু টাকাপয়সা দেয় চেয়ে নিয়ে যায়। সেবার মধুপুরেও ঠিক তাই হল। সকালে মামিমা তরকারি কুটছেন, একজন গয়লার মেয়ে এসে কী চমৎকার খোয়া ক্ষীর বিক্রি করে গেল। পরদিন বিকেলে একজন ঝোলা ঝোলা পোশাক-পরা ফিরিঙ্গি পাদ্রি এসে মামার কাছে পোস্টাপিসের রাস্তা জিজ্ঞাসা করে, আধ ঘণ্টা বসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় ইংরাজিতে গির্জার ঘণ্টা মেরামতের গল্প করে গেল। তার পরদিন আবার দেখি যে দশ-মুন্ডুওয়ালা রাবণরাজা সেজে এসেছে। গুপেরা হইচই করে উঠল। মামিমার ছোটো মেয়ে বুচকি ভয় পেয়ে খুব খানিকটা কাঁদল। তার পরদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর অন্ধকার বারান্দায় খট খট শব্দ শুনে ভোদা বাইরে গিয়ে দেখে কী সর্বনাশ, থামে ঠেস দিয়ে বিকট একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে, বাতাসে তার হাত দুটো একটু একটু দুলছে, আর হাড়গোড় থেকে খটাখট শব্দ হচ্ছে। ভেঁদা দারুণ ভয় পেয়েছিল, কিন্তু গুপে এসেই বলল, এই বহুরূপী! তুমি তো ভারি চালাক হয়েছ! অমনি কঙ্কালটা এমন করে অন্ধকার ঝোঁপের পাশে গা ঢাকা দিল যে সত্যি মনে হল বুঝি মিলিয়ে গেল? ততক্ষণে মামাও বেরিয়ে এসেছেন, ধমক দিয়ে বললেন, এই বহুরূপী, সাজতে হয় মজার মজার সাজ করো। এইরকম ভয়াবহ চেহারা করে এলে ছেলেপিলেরা ভীতু হয়ে যাবে যে। অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা খিলখিল হাসি শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ। বড়োদের অনেকেরই নাকি গায় কাঁটা দিচ্ছিল!