বনের ধারে যারা বাস করত তাদেরই হত মুশকিল। আগুনের দাপাদাপি বন্ধ করবার জন্য পাহাড়ের গোড়া থেকে চুড়ো পর্যন্ত, অনেকখানি জায়গা জুড়ে, গাছপালা কেটে ফেলে, চওড়া একটি ঘাসজমি করে রাখা হত। তার একদিকে আগুন লাগলে, অতখানি খোলা জায়গা পার হয়ে অন্য ধারে আগুন পৌঁছোনো শক্ত হত।
পাহাড়ের বাসিন্দারা ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে আগুনের সঙ্গে লড়াই করত। এক পাহাড়ের মাথা থেকে উঁচু গলায় কু-উই-ই বলে ডাক দিত। পাহাড়-দেশে এক চুড়ো থেকে আরেক চুড়োয় মানুষের পৌঁছতে হলে অনেক খানাখন্দ বন-বাদাড় ভেঙে যেতে হত, কিন্তু শব্দ পৌঁছোত এক নিমিষে। অমনি যত গাঁ খালি করে, সবাই মিলে, পাতাসুদ্ধ গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত পিটিয়ে পিটিয়ে আগুন নেভাতে।
আর বনের যত পশুপাখি, তারা সব দলে দলে বন ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করত। বনের জানোয়ার আগুনকে যত ভয় করে, আর কিছুকে ততটা করে না। অন্য জানোয়ারের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকা যায়, গাছের ডাল-পাতার রঙের সঙ্গে গায়ের রং মিশিয়ে দিয়ে। অন্য জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করা যায়, নখ দিয়ে, শিং দিয়ে, খুর দিয়ে, দাঁত দিয়ে। কিন্তু আগুনের কাছ থেকে পালানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।
অন্য সময় জন্তু-জানোয়ারদের ভারি গর্ব; তাদের হারাতে গিয়ে মানুষকে নাস্তানাবুদ হতে হয়। একটা পাখি ধরবার জন্য কায়দা কত, একটা হরিণ মারবার জন্য কত তোড়জোড়। তাও সামনাসামনি সোজাসুজি নয়, লুকিয়ে জাল পেতে, খাবার দিয়ে ভুলিয়ে তবে-না পাখি ধরে; বন্দুক নিয়ে, শিকারি নিয়ে, বন পিটিয়ে তবে-না জানোয়ার মারে। আর তারা লড়ে খালি হাতে, শুধু তাদের জানোয়ারের বুদ্ধি আর জানোয়ারের শক্তি দিয়ে। কিন্তু আগুনের কাছে তাদের সব গর্ব খাটো হয়ে যায়। হুড়মুড় করে কাচ্চা-বাচ্চা বুকে চেপে, তারা বন থেকে বেরিয়ে পড়ে।
তবে পাহাড়-দেশের লোকেরা আগুন লাগার সময় জানোয়ার মারত না, সবাই মিলে আগুনের সঙ্গে লড়ত।
আমাদের দুধ দিত ডোরাক; শুকনো বুড়ো, মাথায় পশমের পাগড়ি বাঁধা, দু-কানে দুটি পলা পরা। তার বাড়ি ছিল বনের ধারে, ঘাসজমির গা ঘেঁষে। ঘাসজমির ঢালুতে তার গোরু-ছাগল চরত। তাদের গলায় ঘন্টা বাধা থাকত, সারা দিন পাহারা দিতে হত। বনের মধ্যে কত জানোয়ারের বাস কে তার খবর রাখে। তবে বড় জানোয়ার থাকলেও টের পাওয়া যেত না। ডোরাক বলত সহজে ওরা খোলা জায়গায় মানুষের বাসের কাছে আসে না, যদি-না খিদের তাড়নায়, কী তার চেয়েও প্রবল কোনো রাগের বশ হয়ে আর সব ভুলে যায়।
একবার ডোরাক আমাদের ওই বনের মধ্যে নিয়ে গেছিল। চারদিকে শীতের শেষের রোদ ঝিলমিল করছে, কিন্তু বনের মধ্যেটা ঘন ছায়ায় ঢাকা, পায়ের নীচের মাটিটা স্যাঁতসেঁতে, তার ওপর সরল গাছের পাতা পড়ে পুরু গালচের মতো হয়ে রয়েছে। সরল গাছের মিষ্টি ধুনোর গন্ধের সঙ্গে, কেমন একটা জানোয়ারদের উগ্র গন্ধ মিশে রয়েছে, কিন্তু কোথাও কাকেও দেখা যাচ্ছে না।
গাছের গোড়ায় প্রকাণ্ড সব ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে, ডালে ডালে ফিকে সবুজ আগাছা বুড়ো মানুষের দাড়ির মতো ঝুলে রয়েছে; ধরে একটু টানলেই পড় পড় শব্দ করে শেকড়সুদ্ধ উঠে আসে।
সেখানে ফিসফিস ছাড়া কথা কইতে ইচ্ছে করে না। ডোরাকের কানে কানে বললাম, তারা কোথায়?
ডোরাক আমাদের শুকনো পাতা দিয়ে মোড়া গাছের কোটর দেখাল। পাথরের ফাটলে নরম শুকনো শ্যাওলার বিছানা দেখাল। মাথার অনেক ওপরে গাছের ডালে পাতার মধ্যে অন্ধকারের ভেতর জটা মতন দেখাল। তার বেশি কিছু নয়। দূর থেকে অনেক বার যেন চকচকে চোখ দেখেছিলাম, কাছে গেলেই কিছু নয়; বোধ হয় যে যেখানে চোখ বুজে, ডানা মুড়ে বসে থাকে। মানুষকে তারা বড়ো ভয় করে।
বনের মাঝে মৌ গাছ দেখলাম। সে কোনো একরকম গাছই নয়। ঝাউ গাছ, সরল গাছের মাঝখানে একটা মস্ত মরা গাছ, ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে, একটাও পাতা নেই। কিন্তু গাছের খাঁজে খাঁজে ফাটলে ফোকরে শত শত মৌচাক। আর চারদিকে মৌমাছিদের সে কী গুঞ্জন, কান যেন ঝালাপালা হয়ে গেল।
ডোরাক ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে আমাদের সাবধান করে দিল। কিছু দূরে নিয়ে গিয়ে বললে, ও গাছের সন্ধান এখনও কেউ পায়নি। জানলেই দলে দলে এসে, গভীর রাতে গাছের গোড়ায় আগুন দিত। মৌমাছিরা অমনি অন্ধের মতো সব চাক ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত, আর মানুষরাও সমস্ত মধু লুটেপুটে নিয়ে যেত। ডোরাক বললে, তোমরাও যেন কারো কাছে মৌ গাছের গল্প কোরো না। তাহলে লাখ লাখ মৌমাছির প্রাণ যাবে, মৌ গাছ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
পাথরের ফাঁকে ডোরাক দেখাল সবুজ সাপ ঘুমুচ্ছে। গায়ের আঁটো চকচকে খোলসটা ঢিলে হয়ে গেছে। ডোরাক বললে, সারা শীতকাল ঘুমুবে সাপটা। বললে, একসময় নাকি পুরোনো খোলসটা ছেড়ে দেবে, নতুন খোলস গজাবে। ক-দিন শরীরটা নরম তুলতুলে হয়ে থাকবে, একটু কিছুতেই ব্যথা লাগবে; তারপর নতুন খোলসটাও আঁটো, শক্ত, মজবুত হয়ে উঠবে। বললে, ভালুকরাও নাকি সারা শীত ঘুমিয়ে কাটায়।
ডোরাক আমাদের ওর বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেছিল, বাইরে দড়িতে শুঁটকিমাছ শুকুতে দিয়েছে দেখেছিলাম। বনের ধারে বাড়ি, উঠোন পেরুলেই ঘাসজমি, তার ওপারে ঘন বন। সেই দিকে চেয়ে চেয়ে আমরা কচি ছোলা মধু দিয়ে খেলাম।