মামা মাঝে মাঝে খুব রাত করে বাড়ি ফিরত। আর দোতলায় একা একা আমি তো ভয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতাম। শিবুদের কাছে সেকথা জানাতেই, যে দিনই মামা বেরোতেন, সে দিনই ওরা জলের পাইপ বেয়ে উপরে উঠে, বারান্দায় বসে আমার সঙ্গে কত যে গল্প করত তার ঠিক নেই। সব মাঝিদের গল্প, ঝড়ের কথা, নৌকাডুবির কথা, কুমির আসার কথা, হাঙর মারার কথা, সমুদ্রের কথা।
ওদিকে স্কুলের ঝগড়া বাড়তে বাড়তে এমন হল যে, ওই জগু, ভুটে, আর নেলে বলে ওদের যে এক শাকরেদ জুটেছে, এই তিন জনকে অন্তত আচ্ছা করে শিক্ষা না দিলে চলে না। শিবু বললে, বাবু, এইখানে ডেকে এনে সবাই মিলে কষে পিটুনি লাগাই।
বললাম, না রে, শেষটা ইস্কুল থেকে নাম কাটিয়ে দেবে। তার চেয়ে এখানে এনে এমনি ভূতের ভয় দেখাই যে, বাছাধনদের চুল-দাড়ি সব খাড়া হয়ে উঠবে।তাই শুনে ওরা তিন জনেই হেসেই লুটোপুটি।
আমি বললাম, দেখ, তোদের তিন জনকে কিন্তু ভূত সাজতে হবে আর আমি ওদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আনব। তোদের সব সাজিয়ে-গুজিয়ে দেব।
আঁ! সেজিয়ে-গুজিয়ে দেবেন কেনে বাবু? রংটং মেখিয়ে দেবার দরকার হবে না। তিনটে চাদর দেবেন। আমরা সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে, গঙ্গার ধারে ঝোঁপের মধ্যে এমনি এমনি করে হাত লাড়তে থাকব আর ওঁ ওঁ শব্দ করব, দেখবেন ওনাদের পিলে চমকে যাবে। ছেঁড়া চাদর ধুতি যা পেলাম তিনটে দিয়ে দিলাম। সত্যি ওদের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না! ভালোই হবে, তাহলে আমাকে কেউ সন্দেহও করবে না, বাড়িটার একটা অপবাদ তো আছেই।
শুক্রবার ইস্কুলে গিয়ে জগু ভুটেদের সঙ্গে কথা বন্ধ করলাম। বাবা! ওদের রাগ দেখে কে! কী রে, হতভাগা, ভারি লাট সায়েব হয়েছিস যে? কথা বলছিস না যে বড়ো?
বললাম, মেয়েদের সঙ্গে আমি বড়ো-একটা কথা বলি না। ব্যাচেলর মামার শিক্ষা।তারা তো রেগে কাই, মেয়েদের সঙ্গে মানে? মেয়েদের আবার কোথায় দেখলি?
বললাম, যারা ভূতের ভয়ে আমাদের বাড়ি যায় না, তাদের সঙ্গে মেয়েদের আবার কী তফাত?
জগু রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, যা মুখে আসবে, খবরদার বলবি না, গুপে।
এক-শো বার বলব, তোমরা ভীতু, কাপুরুষ, মেয়েমানুষ। জগু আমাকে মারে আর কী! শুধু অঙ্কের মাস্টারমশাই এসে পড়লেন বলে বেঁচে গেলাম।
স্কুল ছুটির সময় ভুটে পিছন থেকে এসে আমার কানে কানে বললে, সন্ধ্যে বেলা সাতটার সময় তোমাদের বাড়ির বাগানে আধ ঘণ্টা ধরে আমরা বেড়াব। দেখি তোমাদের ভূতের দৌড় কতখানি!, আমাদের চিনতে এখনও তোমার ঢের বাকি আছে।
আমি তো তাই চাই; শিবুরা আজকের কথাই বলে রেখেছিল।
বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরলাম, ওদের দেখতে পেলাম না। একটু একটু নার্ভাস লাগছিল, যদি ভুলে যায়। নদীর ধারে একটা ঝোঁপের পিছন থেকে গুজি ডেকে বলল, বাবু, সব ঠিক আছে আমাদের। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই জগু, ভুটে, নেলো তিন কাপ্তেন এসে হাজির।
বড়ো মামা বেরোচ্ছিলেন, ওদের দেখে আমাকে বললেন, বন্ধুদের কেষ্টনগরের মিষ্টিটিষ্টি দি, সব একা একা খেয়ে ফেলিস না যেন। কথাটা যেন না বললেই হত না। ওরা তো হেসেই গড়াগড়ি, যেন ভারি রসিকতা হল।
বড়ো মামা গেলে, খাওয়া-দাওয়া সেরে বাগানে গেলাম। এক্ষুনি বাছারা টের পাবেন! চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটু একটু চাঁদের আলোতে সব যেন কীরকম ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে, আমারই গা ছমছ করছে। গল্প করতে করতে ওদের গঙ্গার ধারের সেই সরু রাস্তাটাতে নিয়ে এলাম। বাড়ি থেকে এ জায়গাটা আড়াল করা। পথের বাঁক ঘুরতেই, আমার সুষ্ঠু গায়ে কাঁটা দিল– ঝোঁপের পাশে তিনটে সাদা মূর্তি! মাথা মুখ হাত সব ঢাকা, আবার হাত তুলে তুলে যেন ডাকছে আর অদ্ভুত একটা ওঁ ওঁ শব্দ! একটু একটু হাসিও পাচ্ছিল।
জগুরা এক মিনিটের জন্য ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, তবে রে হতভাগা! চালাকি করবার জায়গা পাসনি! বলে ছুটে গিয়ে চাদরসুদ্ধ মূর্তিগুলোকে জাপটে ধরল।
তার পরের কথা আমি নিজের চোখে দেখেও যখন বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমরা আর কী করে করবে? ছোঁবামাত্র মূর্তিগুলো যেন ঝুরঝুর করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, শুধু চাদর তিনটে মাটিতে পড়ে গেল।
জগু, ভুটে, নেলোও তক্ষুনি মূর্ছা গেল।
আমি পাগলের মতো, ও শিবু, ও সিজি, ও গুজি করে ছুটে বেড়াতে লাগলাম। গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল আর গোলযোগ শুনে বন্ধু, নটবর আর ঝগড়ু হল্লা করতে করতে এসে হাজির হল। ওরা জগুদের তুলে, ঘরে নিয়ে গিয়ে, চোখে মুখে জল দিল। আমার গায়ে মাথায়ও মিছিমিছি এক বালতি জল ঢালল।
মামাকেও পাড়া থেকে ডেকে আনা হল। এসেই আমাকে কী বকুনি!
বল লক্ষ্মীছাড়া, চাদর নিয়ে গিয়েছিলি কেন?
যত বলি শিবু-সিজি-গুজির কথা, কেউ বিশ্বাস করে না।
তারা আবার কে? এতদিন আছি, কেউ তাদের কোনদিনও দেখেনি শোনেনি; এ আবার কী কথা? আন তাহলে তাদের খুঁজে। কিন্তু তাদের কি আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়? তারা তো আমার চোখের সামনে ঝুরঝুর করে কর্পূরের মতো উবে গেছে।
বনের ধারে
ছোটোবেলায় পাহাড়ে দেশে থাকতাম। চারদিকে ছিল সরল গাছের বন। তাদের ছুঁচের মতো লম্বা পাতা, সারা গায়ে ধুনোর গন্ধ, একটুখানি বাতাস বইলেই শোঁ শোঁ একটা শব্দ উঠত। শুকনো সময় গাছের ডালে ডালে ঘষা লেগে অমনি আগুন লেগে যেত; সরল গাছের ডালপালা ভরা সুগন্ধ তেল, সেও ধু ধু করে জ্বলে উঠত। বাতাসের মুখে সেই আগুন ছুটে চলত, মাইলের পর মাইল পুড়ে ছাই হয়ে যেত। ঘন সবুজ বন মাঝে মাঝে পুড়ে ঝলসে থাকত।