পিছন থেকে গাড়োয়ানদের ছোটো ছোটো ঘোড়াগুলো চেঁচিয়ে উঠল, কক্ষনো সইব না! সইব না! সইব না! মিটিং করে, রেজলিউশন করে, দানা না খেয়ে মানুষদের জব্দ করব!
হলদে ঘোড়া ঠ্যাং তুলে ওদের চুপ করিয়ে দিল, টুনুর মনে হল সে নিজের ছাড়া আর কারুর গলার আওয়াজ সইতে পারে না।
এক কোণে লালু রতন দাঁড়িয়েছিল, হলদে ঘোড়া হঠাৎ লালুকে বলল, আপনি প্রবীণ ব্যক্তি! আপনি কিছু বলুন। বলবামাত্র লালু তড়বড় করে টব থেকে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বিনা ভূমিকায় আরম্ভ করলে :
বহুকাল ধরে আমি চৌধুরিদের বাড়িতে থাকি। তাদের মতন ছোটোলোক আর জগতে নেই– টুনুর শুনে ভারী দুঃখ হল। তার ওপর তারা এমন নিরেট মুখ যে বড়োবাবু পর্যন্ত সামান্য–যাক আমি কখনো কারো নিন্দে করি না। ওদের বাড়ির ছেলেগুলো আহাম্মুকের একশেষ। আমি শিক্ষা দেবার জন্য ইচ্ছে করে ওদের কাপড় রোদে দিলে মাড়িয়ে দিই, জানলা দিয়ে ঘরে মুখ বাড়াই, বোকারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে চিনি খেতে দেয়, আর কেউ যখন দেখছে না গিন্নির হিসেবের খাতা চিবিয়ে রাখি। তা ছাড়া নোংরা জিব দিয়ে ওদের সইসের মুখ চেটে দিই, ছোটো ছেলে একা পেলেই তেড়ে গিয়ে পা মাড়িয়ে দিই, এইরকম নানা উপায়ে জাতির মান রক্ষা করি।
সবচেয়ে বিশ্রী ওদের টুনু আর হাবু বলে দুটো পোষা বাঁদর। অমন বদ চেহারার বাঁদর কেউ যে পোষে জানতাম না। ওরা আমাদের ঘুমের সময়ে এসে ঘেমো হাতে উলটো করে আমাদের গায়ে হাত বুলোয়, এমন ঘেন্না করে যে কী বলব! আবার পাতায় করে যত অখাদ্য জিনিস এনে গদগদ হয়ে শুয়োরের মতো ছুঁচলো মুখ করে, চুচু শব্দ করে খাওয়াতে চেষ্টা করে–ইচ্ছে করে দিই ঘেঁচে! কিন্তু অমন নিকৃষ্ট জীবকে মারতেও ঘেন্না করে।
.
টুনু বিশ্বাসঘাতক লালুর কথায় অবাক হয়ে গেল, এমন অকৃতজ্ঞতা দেখে তার বড্ড কান্না পেল! ছি, লালুর জন্য দাদামশাই ভালো দানা আনান– সে কথা কই লালু তো বলল না! রতনের নতুন জিনের কথাও বোধ করি সে, ভুলে গেছে! টুনু প্রতিজ্ঞা করল আর কখনো আস্তাবলের দিকে যাবে না, ঘোড়া চড়তেও সে চাইবে না। লালুকে সে কত ভালোবাসে আর লালুর তাকে নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে! টুনু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেই চমকে দেখল, সে কখন জানি মেজোমামার ঘরে এসে শুয়ে রয়েছে আর লালুটাও ইতিমধ্যে এসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মেজোমামার হাত থেকে চিনি খাচ্ছে!
টুনুর বড্ড রাগ হল, ডেকে বলল, দিয়ো না ওকে মেজোমামা, ও বলেছে আমরা আহাম্মুক ছোটোলোক, নিকৃষ্ট বলে মারতেও ঘেন্না করে! মেজোমামা আহাঃ! বলে টুনুকে চুপ করিয়ে দিয়ে একমনে চিনি খাওয়াতে লাগলেন। টুনু হাঁ করে দেখল লালু দিব্যি চিনি সাবাড় করল, কিন্তু যাবার সময় মনে হল চোখ টিপে জিব বের করে বিশ্রী ভেংচে গেল! কিন্তু সে কথা কাকেই-বা বলে।
নটবরের কারসাজি
নেই ছেলেটা প্রথম যেদিন মাস্টারমশাইয়ের পিছন পিছন ক্লাসে ঢুকল, গায়ে নীল ডোরাকাটা গলাবন্ধ কোট আর খাকি হাফ-প্যান্ট, চুলগুলো লম্বা হয়ে নোটানোটা কানের উপর ঝুলে পড়েছে, তেল-চুকচুকে আহ্লাদে আহ্লাদে বোকামতন ভাবখানা দেখেই আমার গায়ে জ্বর এল। আবার আমোদও লাগল, একে নিয়ে বেশ একটু রগড় করা যাবে মনে করে।
ছেলেটার পায়ে ফিতে-দেওয়া কালো জুতো একটু কিচকিচ করছিল, তাইতে নগা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, জুতোর দামটা বুঝি আসছে মাসে দেওয়া হবে।
ছেলেটা কিন্তু কিছু না বলে খাতা-পেনসিল নিয়ে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে চুপ করে বসল। মাস্টারমশাই বললেন, ওহে নটবরচন্দ্র, বছরের মাঝখানে এয়েচ, ভালো করে পড়াশোনা কোরো। নাম শুনে আমরা তো হেসেই কুটোপাটি, নগা তক্ষুনি তার নাম দিয়ে ফেলল– লটবহর। সত্যি নগার মতন রসিক ছেলে খুঁজে পাওয়া দায়!
টিফিনের সময় নটবরচন্দ্র একটা ছোট্ট বইয়েরমতন টিনের বাক্স খুলে লুচি আলুরদম খেয়ে, হাত চাটতে চাটতে বার বার আমাদের দিকে তাকাতে লাগল। তাই-না দেখে নগা বললে, কী রে ছোঁড়া, মানুষ দেখে বুঝি অভ্যেস নেই?
আমরা তাগ করেছিলাম, চটেমটে ছেলেটা কী করে দেখব। ছেলেটা কিন্তু খানিক চুপ করে থেকে হঠাৎমুখে হাত দিয়ে বিশ্রী রকম ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে লাগল।নগা রেগে বলল– অত হাসির কথা কী হল শুনতে পারি?
ছেলেটা অমনি নরম সুরে বলল– কিছু মনে কোরো না ভাই, সত্যি আমার হাসা উচিত হয়নি, কিন্তু তোমাদের দেখে আমার হঠাৎ মেজোমামার পোষা বাঁদরগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কেবল ওই ওকে ছাড়া বলে আমাকে দেখিয়ে দিল।
নগারা রেগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, আমি কিন্তু একটু খুশি না হয়ে পারলাম না, অল্প হেসে জিজ্ঞেস করলাম আর আমাকে দেখে কীসের কথা মনে হচ্ছে?
সে অম্লানবদনে বললে–মূলতানি গোরুর কথা।ভীষণ রাগ হল। ভাবলাম ছোটোবেলা থেকে এই যে শ্যামবাবুর কাছে স্যান্ডো শিখেছি সে কি মিছিমিছি! তেড়ে গিয়ে এইসা এক প্যাঁচ কষে দেবার চেষ্টা করলাম যে কী বলব! সে কিন্তু কী একটা ছোটোলোকি কায়দা করে এক সেকেন্ডে আমাকে আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল। ঠিক তক্ষুনি ক্লাসের ঘণ্টা পড়ল, নইলে তাকে বিষম সাজা দিতাম।
ক্লাসের পর বাড়ি যাবার পথে তার জন্য ওত পেতে রইলাম, আমি আর একটা ছেলে। দেখা হতেই সে হাসিমুখে বলল, কী হে, চীনাবাদাম খেতে আপত্তি আছে? আমরা আর কী করি একেবারে তো আর অভদ্র হতে পারি না, তাই চীনাবাদাম নিয়ে তাকে বুঝিয়ে বললাম দেখ, নতুন ছেলে এসেছিস, নতুন ছেলের মতো থাকবি, আজ দয়া করে তোর চীনাবাদাম খেলুম বলে যেন মনে করিস না যে দুপুরের কথা ভুলে গেছি।