একবার অনেক রাতে নন্দ কোথা থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ঘরে ফিরছিল। তখন নিজের চোখে দেখেছিল ছোটো ছোটো টিমটিমে আলো নিয়ে কারা যেন ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করছে। তাই দরজার সামনে এসে নন্দ একবার থামল। বেশ রাত হয়েছে, বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে, কেমন অদ্ভুত একটা আওয়াজ হচ্ছে। হাওয়া তো রোজই দেয় আজকাল, কিন্তু এ-রকম তো কখনো মনে হয় না।
নন্দ দরজা খুলল, চামচিকের খোকার কান্নার মতন একটা শব্দ হল। একটা বড়ো সাইজের ঠ্যাঙে লোমওয়ালা মাকড়সা সড়সড় করে নন্দর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।
প্রথম সিঁড়িতে পা দেবার আগে নন্দ উপর দিকে তাকাল, যতদূর দেখা যায় সিঁড়ি ঘুরে পাঁচ তলার ছাদ পর্যন্ত উঠেছে, আর নীচের দিকে যতদূর দেখা যায় ঘুরে ঘুরে এক তলার শানবাঁধানো গলি পর্যন্ত নেমেছে।
সিঁড়ির রেলিংটা ক্যাঁ-কোঁ করে নড়ে উঠল, কার জুতো জানি চাপাগলায় মচমচ করে উপর থেকে নেমে আসতে লাগল। নন্দর হাত-পা হিম হয়ে গেল, অন্ধকারে দেয়ালের গায়ে চ্যাপটা হয়ে টিকটিকির মতন লেগে রইল।
তারপর দেখল বুড়ো-আঙুল-বার-করা, জিভ-কাটা ছেঁড়া হলদে বুট-পায়ে, তালি-দেওয়া সুতো-ঝোলা লম্বা পেন্টেলুন-পরা দুটো ঠ্যাঙ সিঁড়ির বঁক ঘুরে নামতে লাগল। তারপর দেখল, পিঠে তার মস্ত ঝুলি, থুতনিতে খোঁচা দাড়ি, নাকের উপর আঁচিল, তার উপর তিনটে লোম, ন্যাড়া মাথায় নোংরা টুপি বোঝ হয় সেই হিংস্র লোকদের কেউ একজন! ভয়ের চোটে নন্দর একপাটি চটি ছিটকে খুলে, ঠুংঠং করে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নীচে চলল, আর সেই হলদে বুটপরা হিংস্র লোকটা থতমত খেয়ে বোঁচকা ফেলে দে ছুট!
নন্দর কিন্তু আর কিছু মনে নেই। কেমন ভেড় বানিয়ে গিয়েছিল! লোকটা কিন্তু নিজেই টেনে কোথায় দৌড় লাগাল!
.
এদিকে পাঁচ তলার লোকেরা আজও গল্প করে নন্দ নামে একটি ছোটো ছেলে চোর ভাগিয়ে জিনিস বাঁচিয়েছিল।
শুনে শুনে নন্দ মনে ভাবে– বুড়োরা কী হাঁদা! কিন্তু বাইরে কিচ্ছু বলে না, চালাক কিনা!
দিন-দুপুরে
দুপুর বেলা বাড়িসুদ্ধ সব্বাই ঘুমোচ্ছে। বাবা ঘুমোচ্ছেন, মা ঘুমোচ্ছেন, মেজোমামা পর্যন্ত এ খবরের কাগজে মুখ ঢাকা দিয়ে বেজায় ঘুমোচ্ছন। কিন্তু টুনুর আর ঘুমই আসে না। তাকিয়ে দেখল হাবুটা অবধি চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে আছে। তাকে ডাকা চলে না মেজোমামা যদি জেগে যান! টুনু শুয়ে শুয়ে ভাবছে বাবার নতুন ঘোড়া খুব সুন্দর হলেও দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালুর কাছে লাগে না। লালু কত কালের পুরোনো, সেই কবে মেজোমামা যখন ইস্কুলে যেতেন তখনকার! কীরকম প্রভুভক্ত! ওর গায়ে কী জোর! ভাবতে ভাবতে টুনুর মনে হল– বাদলা দিন বলে বাবা আবার আজ ঘোড়ায় চড়তে বারণ করেছেন। বড়োদের যদি কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে। আচ্ছা, আজকের দিনই যদি ঘোড়ানা চড়বে, তা চড়বে কবে!
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই টুনুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল, চোখ দুটো গোলমাল হয়ে গেল। দেখল দাদামশাইয়ের বুড়ো ঘোড়া লালু কেমন যেন মুচকি হাসতে হাসতে উঠোন পার হয়ে বাবার নতুন ঘোড়া রতনের আস্তাবলে ঢুকল। টুনু উঠে এসে জানলার আড়ালে দাঁড়াল। একটু বাদেই রতন লালু দুজনেই আস্তাবলের কোণ ঘুরে কোথায় যেন চলে গেল।
টুনু ডাকল– ও কেশরী, ও সই-ই-স! লালু-রতন যে পালিয়ে গেল! কিন্তু গলা দিয়ে আর স্বরই বেরুল না। বাইরে এসে ইদিক-ঊদিক তাকিয়ে যখন কেশরী সিং কিম্বা সইসের পাত্তা পেল না, টুনু নিজেই চলল আস্তাবলের কোণ ঘুরে রতন-লালুর পিছন পিছন।
কী আশ্চর্য! আস্তাবলের পিছনে সেইসব ধোপাদের কুঁড়ে ঘর, তার সামনে নোংরা মাঠে ধোপাদের গাধা বাঁধা থাকত, আর ময়লা দড়িতে সাহেবদের কোট পেন্টেলুন রোদে শুকুত, সেইসব গেল কোথায়? টুনু দেখল দু-পাশে গা ঘেঁষে ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনোটা আলু কাবলির, কোনোটা লাল-নীল পেনসিলের, কোনোটা কাঁচের মার্বেলের। চারিদিকে দোকানে দোকানে বড়ো বড়ো নোটিস ঝোলানো।
এগজিবিসন!
এই দিকেà
আর একটা দাড়িমুখো মোটকা বুড়ো একটা ফুটো বালতি পিটোচ্ছে আর ষাঁড়ের মতন গলায় চাঁচাচ্ছে পয়সা না ফেলেই ঢুকে যান! পয়সা-টয়সা কিছু চাই না, গেলেই বাঁচি!
টুনু আরও এগজিবিশন দেখেছিল, কতরকম আশ্চর্য জিনিস থাকে সেখানে: দোকান, বাতিওয়ালা থাম, বায়স্কোপ, নাগরদোলা, গোলকধাঁধা!
তাই টুনু তাড়াতাড়ি চলল, মাঝপথে একটা ষণ্ডামার্কা লোক পথ আগলে বলল, এইয়ো! টুনু তাকে দেখতেই পেল না, পায়ের ফাঁক দিয়ে সুট করে গলে এগিয়ে চলল।
হঠাৎ একটা মস্ত খোলা জায়গায় উপস্থিত হল, তার যেদিকে তাকায় কেবল ঘোড়া! বড়ো ঘোড়া, ছোটো ঘোড়া, সাহেবের ঘোড়া, গাড়োয়ানের ঘোড়া, ভালো ঘোড়া, বিশ্রী ঘোড়া। আবার একটা মড়াখেকো হলদে ঘোড়া, ওলটানো টবে চড়ে গার্গেসে গলায় বক্তৃতা দিচ্ছে :
হে ব্যাকুল ঘোড়াভাই-ভগিনী, আজ আপনারা কীসের জন্য এখানে আসিয়াছেন? পুরাকালে আপনারা বন-বাদাড়ে সুখে বিচরণ করিতেন, এই দুষ্ট মানুষগুলাই তো আপনাদের পাকড়াও করিয়া বিশ্রী গাড়িতে জুতিয়াছে। পায়ে নাল বাঁধাইয়া, পিঠে জিন চড়াইয়া, দুই পাশে অভদ্রভাবে ঠ্যাং ঝুলাইয়া চড়িয়া বেড়াইতেছে। ছিঃ! ছিঃ! আপনারা কী করিয়া এই দু-পেয়েদের কুৎসিত চেহারা সহ্য করেন?