তিনি কি প্যাচা?
দুৎ! তারপর ছেলেটা একটা কথা বললে যেটা মা একদম বলতে বারণ করেছেন। নেড়ু বললে ছি!– আচ্ছা, তাঁর পা কি উলটোবাগে লাগানো?
এবার ছেলেটা বেদম রেগে গেল। ভুরু কুঁচকে, ফেসফাস করতে লাগল, আর হাতটাকে ঘুসি পাকাতে আর খুলতে লাগল, যেন এই পেলেই সাবড়ে দেয়। তারপর কী ভেবে ঠান্ডা হয়ে বললে—
ওই যে মিস্ত্রিগুলো সারাদিন বাঁশের টঙে চড়ে তোমাদের বাড়ির বিশ্রী জানালাগুলোতে তোমার গায়ের রঙের মতন বদ সবুজ রং লাগায়, ওদের একটা দড়িবাঁধা রঙের টিন, আর একটা বড়ো চ্যাপটা রং লাগাবার জিনিস যদি আমাকে এক্ষুনি না এনে দাও তাহলে তোমাকে, তোমার বাবাকে, তোমার দাদাকে, আর তোমার মাকে কচুকাটা করব। তোমাদের ছোটো খুকিকে পানের মশলা বানিয়ে কড়কড়িয়ে চিবিয়ে খাব। তোমাদের মাসি-পিসি যে যেখানে আছে তাদের থেতলোকরব! তোমাদের রুটিওয়ালা, ঘিওয়ালা, আর যা যা তোমরা রাখ সব কটাকে লম্বা লম্বা ফালি করে ছিঁড়ে কাপড় শুকুবার দড়িতে ঝুলিয়ে শুঁটকি মাছ বানাব। আর তোমার যত বন্ধু আছে সবগুলোকে নুনজল দিয়ে কঁচা কাঁচা গিলে খাব।
বাপরে, কী হিংস্র খোকা!
নেড়ু তাড়াতাড়ি একটা টিন, আর দু-তিনটে বুরুশ তাকে দিয়ে এল। ছেলেটা ফ্যাচফ্যাচ করে। হাসতে হাসতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
রাতে নেড়ু শুনতে পেল ফিসফিস করে কারা কথা বলছে। কানে আঙুল দিয়ে শুল, তবু মনে হল কে যেন বলছে–
আছে– আছে!
নিম গাছে!
নেড়ু ভাবলে, ওরে বাবা, কী আছে রে?– পান্তভূত? কবন্ধ? পিশাচ? স্কন্ধকাটা? গন্ধবেনে? শাঁখচুন্নি? পেতনি? প্যান্তাখেচি?
নেড়ু তো নাক-মুখ ঢেকে রাম ঘুম লাগ।
.
পরদিন সকালে নীচে যাবার সময় সিঁড়ির জানলা দিয়ে দেখে, রাস্তায় ওবাড়ির বড়ো কর্তা, এবাড়ির দরোয়ান, দাদা, বাবা, মন্টুর বাবা, দিনদা, আরও কত কে। সবাই ঠ্যাং হাত ছুঁড়ে বেজায় চাঁচাচ্ছে!
নেড়ু, আরও দেখল রাস্তার সব বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সবুজ রং দিয়ে নানানরকম চিত্তির করা, পাশের বাড়ির সাদা গেটটা ডোরাকাটা!
হঠাৎ নেড়ুর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবার জোগাড় করল– সেই হিংস্র ছানাটা পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে রভের বুরুশ, আর-এক হাতে রঙের টিন, এক কান ওবাড়ির। দরোয়ান ধরেছে, আর-এক কান এবাড়ির লছমন সিং। আর ছেলেটা জোরসে চেল্লাচ্ছে।
তারপর ভঁকভঁক করে একটা মোটর ডাকল, আর পথ ছেড়ে সকলে চলে এলেন। লছমন সিংও কানে শেষ একটা প্যাঁচ দিয়ে খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেড়ে দিল। তারপর ওদের বাড়ির দরজায়ান ওর হাত থেকে খামচা মেরে রঙের টিন আর বুরুশ নিয়ে গেল, হিন্দিতে আর বাংলাতে বিড়বিড় কীসব বকতে বকতে, শুট মারতে মারতে ওদের বাড়ি দিয়ে গেল!
নেড়ু, পাড়াসুদ্ধ সক্কলের সাহস দেখে এমন হাঁ হয়ে গেল যে দেখতেই ভুলে গেল ছেলেটার পা উলটোবাগে লাগানো কি না!
লক্ষ্মী ছেলে
এক বেজায় জ্যাঠা ছেলে ছিল। যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন, ততদিন সে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টো টো করে বেড়িয়েছে। শেষটায় যখন বাবা মারা গেলেন, তখন ছেলে ভারি বিপদে পড়ল। কী করে। লেখাপড়া তো আর বেশি জানে না, যে কাজ করে খাবে? তখন সে ভাবল, আমার তো আর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। শুধু আছেন মামা। তিনি আবার আমার উপরে চটা। কী আর করি? তার কাছেই যাই। এই-না,ভেবে সেই দিনই দুপুর বেলা সে মামা বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। মামা এদিকে খেয়ে-দেয়ে দিব্যি ঘুম দিচ্ছেন। তার চেঁচামেচিতে তার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চটে বললেন, হতভাগা। কী করতে এসেছিস? কী চাস?
–আজ্ঞে এখানে থাকতে এসেছি।
মামা আর কী করেন বললেন, আচ্ছা থাক। দেখিস বাঁদরামি করিস না।
সেখানে সে বেশ আছে। খায় দায় ঘুম দেয়। একদিন তার মামি বললেন, ওই হাঁড়িতে রসগোল্লা আছে, দেখিস, কেউ যেন খায় না। এই বলে যেই মামি অন্য ঘরে গেছেন, শ্রীমান সব রসগোল্লা গিলেটিলে বসে আছেন।
একটু পরেই মামি ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কে রসগোল্লা খেয়েছে রে? ছেলে সাধুর মতন বলল, আজ্ঞে আমি।
কেন রে?
খিদে পেয়েছিল বলে।
মামি এসব দেখে হাড়ে হাড়ে চটে গেলেন। ঠিক করলেন, তাকে তাড়াতে হবে। তখন ছেলে ভাবল, তাই তো, মামিকে একটু খুশি করতে হবে।
.
একদিন এক কাণ্ড হয়ে গেল, যাতে মামির মত একেবারে উলটে গেল। তখন বোধ হয় রাত একটা হবে, হঠাৎ মামার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তার মনে হল ঘরের ভিতর কে যেন খচমচ করছে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। টাক মাথায় চুল ক-টা খাড়া হয়ে গেল, কপালে ঘাম দেখা দিল।
অতি কষ্টে বললেন, কে রে? তবু কোনো উত্তর না পেয়ে চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। অমনি কে জানি হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এমন সময় শুনতে পেলেন বাইরে ছেলেটা বলছে, কে মশাই? না বলে চুরি করতে এসেছেন কেন? বলে এলেই তো পারতেন, তাহলে জিনিস সব বের করে রাখতাম, আপনি শুধু নিয়ে যেতেন।
মামি বললেন, দেখো না গিয়ে কে? মামা লেপের তলায় মাথা ঢুকিয়ে শুয়ে ছিলেন, আস্তে আস্তে উঠে দরজাটা একটু ফাঁক করেই দড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে, এক দৌড়ে আবার লেপের তলায় ঢুকলেন। মামি শুনলেন ছেলেটা আবার বলছে, চৌবাচ্চায় নাববেন মশাই? গরমের দিন, আরাম লাগবে। তাছাড়া, সাঁতার শেখা ভালো, যদি কখনো জলে