মাস্টারমশাই একটা পান তক্ষুনি মুখে পুরে দিলেন, একটা বইয়ের মতন দেখতে টিনের কৌটোতে ভরলেন। কলু তাক করে রইল। প্রথমটা কিছু মনে হল না– তারপর ভালো করে দেখল, মনে হল মাস্টারমশাইয়ের কপালের দিকটা কীরকম যেন লম্বাটে দেখাচ্ছে, থুতনিটা যেন। ঢুকে পড়েছে, চোখ দুটোও কীরকম পিটপিট করতে লাগল।
কলুর বুকের ভিতর কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। মাস্টারমশাই বাড়ি যান-না কেন? যদি হঠাৎ ল্যাজ দুলিয়ে হুপ করেন? এমন সময়ে বৃষ্টি থেমে গেল, মাস্টারমশাই ধুতির খুঁটটা কাদা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে গেলেন। কলু ভাবতে লাগল, ক-দিন আর ধুতির খুঁট? অন্য পানটা বিধুশেখর। বোধ হয় আজ রাত্রে চেয়ে নেবে, তারপর সেই-বা ধুতি নিয়ে করবে কী!
.
পরদিন বিকেলে বই নিয়ে কলু অনেকক্ষণ বসে রইল, কিন্তু মাস্টারমশাই এলেন না। সন্ধ্যাবেলা বাবা বললেন, ওরে তোর মাস্টারমশাই যে হেডমাস্টার হয়ে বিষ্টুপুর চলে গেলেন।
কলু ভাবল, বিষ্টুপুর কেন, কিষ্কিন্ধে হলেও বুঝতাম! তারপর বহুদিন চলে গেছে। কলুর নতুন মাস্টার এসেছেন, তার ছেলের নাম বিধুশেখর নয়, তার ছেলেই নেই। তিনি কলুকে রোজ ফুটবলের, ক্রিকেটের গল্প বলেন কিন্তু কলুর থেকে থেকে মনে হয়, অন্ধকারে ওবাড়ির পাঁচিলে দুটো কি ল্যাজঝোলা বসে আছে! একটার মুখ কেমন চেনা চেনা, অন্যটা বোধ হয় বিধুশেখর!
ভূতের ছেলে
রাত যখন ভোর হয়ে আসে তখন ওই তিন-বাঁকা নিম গাছটায় হুতুম প্যাঁচাটারও ঘুম পায়। নেড়ু দেখেছে ওর কান লোমে ঢাকা, ওর চোখে চশমা, ওর মুখ হাঁড়ি। হুতুমটা কেন যে চিল-ছাদের ছোটো খুপরিতে পায়রাদের সঙ্গে বাসা করে না, নেড়ু ভেবেই পায় না। বোধ হয় ভূতদের জন্যে।
নিম গাছতলায় ভূত আছে।
একদিন ভোর বেলায়, মই বগলে ছাগলদাড়ি লোকটা রাস্তার আলো নিবিয়ে নিবিয়ে চলে গেলে পর, নেড়ু দেখেছিল কোমরে রুপোর ঘুনসিওয়ালা, মাথায় গুটিকতক কোঁকড়া চুল, ভূতদের ছোটো কালো ছেলে নিম গাছতলায় কাঁসার বাটিতে নিম ফুল কুড়চ্ছে। নেড়ুকে দেখেই ছেলেটা এক চোখ বুজে বগ দেখাল। নেড়ু, ভাবল, ভূত কিনা, তাই ভদ্রলোক নয়।
তারপর অনেক দিন নেড়ু অনেক বেলা পর্যন্ত গাঁক গাঁক করে ঘুম লাগিয়েছে, শেষটা এমনকী ভজাদা এসে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়েছে। নেড়ু, কিন্তু একটুও রেগেমেগে যায়নি। ও তো আর সুকুমারদা নয় যে মুখ দেখলে বালতির দুধ দই হয়ে যাবে! কিন্তু সেই ছানাটাকে আর দেখা হয়নি।
শেষটা হঠাৎ একদিন নেড়ু স্বপ্ন দেখল কালো ছেলেটা ওকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে নাকের ফুটোয় কাগের নোংরা পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাগের চোটে নেড়ুর ঘুম ছুটে গেল। ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথায় সুপুরি বসিয়ে লাগায় খড়ম! খানিক চোখ রগড়ে, জিভ দিয়ে তালুতে চুকচুক করে চুলকে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, মই বগলে সেই লোকটা। তারপর নিমতলায় তাকিয়ে দেখল ভূতের ছানাটা একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বেজায় হাসছে, যেন কালো ভাল্লুক মুলো চিবোচ্ছে। সে কী বিশ্রী হাসি! গোটা কতক শুট লাগালে হয়!
ছেলেটা নেড়ুকে দেখে আজ আর বগ দেখাল না, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ভূতের ছেলে বাবা! বিশ্বাস নেই! নেড়ুর একটু ভয় করছিল, ঘরের ভিতর এদিক-ওদিক একবার তাকাল। দেখে ভূতের ছেলে কিনা কুঁজোর পিছন থেকে একটা এয়া বড়া টিকটিকি মুণ্ডু বাড়িয়ে, ঘোলাটে চোখ পিটপিট করে ঘুরিয়ে আহ্লাদে আহ্লাদে ভাব করে টিক-টিকটিক করে আবার মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে নিল, কেমন যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব! নেড়ুর ভারি রাগ হল। কী, ভয় পাই। নাকি!
নেড়ু আস্তে আস্তে নীচে গেল। দাঁত মাজল না। চোখ ধুল না। তাতে কী হয়েছে? সেই ছেলেটার তো নাকে সর্দি!
নিমতলায় যাবার পথে দেখে দুই দিকে দেয়ালে খুঁটে। দেওয়া। কতকগুলো গোল গোল মতন, সেগুলো ধোপার। মা দিয়েছে; আর কতকগুলো ঠ্যাংওয়ালা, সেগুলো ধোপার মায়ের মেয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিমতলায় গিয়ে দেখে ছেলেটা কোথায় যেন সটকে পড়েছে। কী। জানি ভোর হয়ে এসেছে, আলো-টালো দেখে উঠে গেল না তো!
সেই দিনই সন্ধ্যা বেলায় নেডুর দাঁত ব্যথা করছিল, তাই লবঙ্গ-জল দিয়ে মুখ ধুয়ে জানলার উপর বসে ভাবছিল, আচ্ছা নেপাল খুড়োর কেনই-বা অমন সিন্ধুঘোটকের মতন গোঁফ, আর বিধুদাই-বা কেন দিনরাত টিকটিক করেন!
এদিকে ওদের বাড়ির দারোয়ান কী যেন গাইছিল, মনে হচ্ছিল–
নিমতলাতে আর যাব না,
কেলো-ভূ-তে-র-কা-লো-ছা-না!
হঠাৎ শুনল, এইয়ো।
চমকে আর একটু হলে ধুপুস করে পড়েই যাচ্ছিল! আবার শুনল, এইয়ো!
চেয়ে দেখে নিমতলায় আবছায়াতে সেই ভূতের ছানাটা! নেড়ু গলা নামিয়ে হিন্দিতে ফিসফিস করে বললে, হাম শুনতে পাতা।
ছানাটা আবার বাংলায় বললে– সকালে কি পায় শেকড় গজিয়েছিল?
নেড়ু বললে, আমি তো গেলুম, তুমিই আলো দেখে চলে গেছিলে।
ছেলেটা বললে, দ্যুৎ, আলো নয়, বাবাকে দেখে।
নেড়ু, ভাবল– কেন, বাবাকে দেখে চলে যাবে কেন? নেড়ু শুধু এক বার বাবাকে দেখে চলে গিয়েছিল সেই যেবার দরোয়ানের হুঁকা টেনেছিল। তাই জিজ্ঞেস করল– হুঁকো টেনেছিলে?
ছেলেটা মাথা নেড়ে বললে, দুৎ। তার থেকে বিড়ি ভালো।
তোমার বাবা কি গাছে থাকেন?
দুৎ! থাকেন না, চড়েন। আমি অনেক তাগ করে থাকি, কিন্তু কক্ষনো পড়েন না!