খালি খালি মনে হচ্ছিল এখানে না এলেই ছিল ভালো। তবু ওপরে গেলাম বুড়ির সঙ্গে।
ধুলোমাখা পুরোনো কাঠের সিঁড়ির ধাপে ধাপে নানা রকমের আওয়াজ হয়। কত জায়গায় রেলিং নেই, কত জায়গায় কাঠে ঘুণ ধরে গেছে। ওপরে গিয়ে দেখি প্রকাণ্ড ঘর, তার দেয়ালময় কতরকম ছবি আঁকা, তার রং সব জ্বলে গেছে, হরিণ, মানুষ কত কী। বুড়ির হাতের তেলের বাতির আলোতে কীরকম মনে হতে লাগল তারা বুঝি নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছে। শীত করতে লাগল।
কাঠের মেঝেতে পুরু হয়ে ধুলো জমেছে, যেন কতকাল কেউ এসব ঘরে বাস করেনি। চলতে গেলে পায়ের চাপে মনে হয় ধোঁয়া উড়ছে।
তবে সামনের দিকের একটা মস্ত ঘর খানিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারটে বিশাল বিশাল তক্তাপোশ, সর্বাঙ্গে কারিকুরি করা, আর কোথাও কোনো আসবাব নেই। তার পাশেই স্নানের ঘর।
বুড়ি তেলের বাতিটি দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রেখে নিজেই আমাদের জন্য বালতি করে গরম জল এনে দিল। সাবান দিয়ে কাঁচা, রোদের গন্ধলাগা চারখানা কাপড় আর গামছাও এনে দিল। ঘন বনের মধ্যে খালি পুরোনো বাড়িতে এত আয়োজন দেখে আমরা সবাই থ।
তার ওপর ঘণ্টা খানেক বাদে, চারখানা কানাতোলা থালায় করে খিচুড়ি আর মাংস এল। চমৎকার রান্না। ঠানদিদি অবিশ্যি কিছু ছুঁলেন না, আমরা তিন জনেই চার থালা মেরে দিলাম। ঠানদিদির জন্য একটু দুঃখ লাগছিল, বললাম, তা হলে কি একটু চুইংগাম খাবে?
চোখ বুজে বললেন, না বাছা, ওসব মুরগির ডিম-লাগানো জিনিস আমি খাই নে জানোই তো।
আসলে ব্যাপার দেখে আমরা যেমনি অবাক হচ্ছিলাম, তেমনি সন্দেহও হচ্ছিল।
খাওয়া-দাওয়ার পর বুড়ি তক্তাপোশে মাদুর বিছিয়ে, চারখানি ছোটো বালিশ দিয়ে গেল। আমরাও তখুনি যে-যার শুয়ে পড়লাম। বাবা! সারাদিনটা যা গেছে।
কিন্তু কিছুতেই আর ঘুম আসে না। ওরা তিন জন দু-একটা কথা বলবার পর চুপ হয়ে গেল, আর আমি বহুক্ষণ জেগে থেকে থেকে কতরকম যে শব্দ শুনতে লাগলাম সে আর কী বলব!
বৃষ্টি তখনও পড়ছে, ঝুপ ঝুপ, ঝম ঝম করে পুরোনো বাড়িটার ছাদে, কোথায় একটা টিনের চালে, চারদিকের বড়ো বড়ো গাছপালার ওপর। নীচে বুড়ি বাসন-কোসন ধুচ্ছে মাজছে। গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে, ভাঙা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, জলের ছাঁট ঘরে আসছে।
মনে হল থেকে থেকে গোরুর ডাকও শুনতে পাচ্ছি। শুয়ে থাকতে পাচ্ছিলাম না, ও ধারের জানলার ভাঙা খড়খড়ির ভেতর দিয়ে দেখলাম একটা টিনের শেডের নীচে একটা পিদিম জ্বলছে আর একজন নিরীহ মতো বুড়ো একটা বিষম হিংস্র আমিষশোর চেহারার গোরু দুইছে। এত রাতে গোরু দোয়ানো কীসের জন্য ভেবে পেলাম না।
যাই হোক, বাড়িতে তা হলে অন্য লোকও আছে। কেমন যেন ভয়টা খানিকটা কেটে গেল।
জানলা থেকে যেই ফিরেছি, অমনি মনে হল আমাদের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।
আমার গায়ের রক্তও জল হয়ে গেল।
০৬. সকাল হয়েছে বলে
সকাল হয়েছে বলে জীবনে এই বোধ হয় প্রথম খুশি হলাম। নইলে অন্য দিন তো প্রায় রোজই আমাকে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামাতে হয়। শুধু যে মাজন-টাজন নেই বলে দাঁত মাজতে হবে না তা নয়, উঠে দেখি রাত্রের ভয়-ভাবনাগুলো দিনের আলোতে দিব্যি মেঘের মতো কেটে গেছে। তবে থেকে থেকে খালি খালি মনে হতে লাগল, তবে কি শ্যামাদাসকাকা ভেলকি জানে? মালা এল কোত্থেকে? এটা যে সে মালা হতেই পারে না, সে-কথা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি।
জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি শেষটি সত্যি সত্যি সূর্য উঠেছে। বৃষ্টির জলে-ধোয়া গাছের পাতায় পাতায় আলো লেগেছে। গাছের মাঝে মাঝে ঝোলানো বিশাল আটকোনা সব মাকড়সার জাল রোদ লেগে ঝিকমিক করছে।
নীচে থেকে শুনলাম গোরুটা যেন খুশি হয়ে ডাকছে, কিছু পেয়েছে-টেয়েছে হয়তো। ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখি রাত জাগার পর ওরা তিন জনেই অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
কী নিয়ে যে ওদের এত ভাবনা ভেবেই পেলাম না। অন্য সময় তো বিরিঞ্চিদার মুখ দেখলেই ঠানদিদির পিত্তি জ্বলে যায়, যা খুশি তাই বলেন। আর শ্যামাদাসকাকাকে পেলে বিরিঞ্চিদাকে ছেড়ে ওকে আগে ধরেন। আর এখন সারাদিন এক গাড়িতে, সারারাত এক ঘরে, অথচ একটা রাগের কথা নেই! এ ভাবা যায় না।
দেখতে দেখতে রোদে ঘর ভরে গেল, ওদের মুখে রোদ পড়ল। বাইরের পাখিরাও মহা গোলমাল শুরু করে দিল। একে একে ওরা সব উঠে বসল। চোখের নীচে কালি, বড়োরা যেমন সকালবেলা চা না পেলে বিরক্ত হয়ে যায়, তেমনি মুখ করে সব কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর উঠে মুখ-টুক ধুয়ে তবে কথা বলতে লাগল।
যতই কথা বলে, মনের ফুর্তিও দেখি ততই বেড়ে যায়। ঠানদিদি বিরিঞ্চিদাকে বললেন, যাক, তাহলে বোধ হয় তোর আর কোনো ভাবনা
বিরিঞ্চিদা আমার দিকে চেয়ে বলল, স-স-স।
আবার একটু বাদেই বিরিঞ্চিদা খুশি হয়ে শ্যামাদাসকাকাকে বলল, কে জানে, বোধ হয় মরেনি, এমনও তো হতে পারে।
শ্যামাদাসকাকা ভীষণ চমকে উঠে বলল, চোপ, ইডিয়ট।
মনে হল রাতের বিপদ কেটে যাওয়াতে ওরা সব অসাবধান হয়ে পড়েছে। হাসি পেল। এমনি সময় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে মনে হল মেলা লোজন আসছে।
জানলার কাছে গিয়ে বাইরে চেয়ে দেখে বললাম, যাক, আর আমাদের কোনো ভয় নেই! পাঁচ-সাতজন পুলিশ-টুলিশ এসে পড়েছে।
যেইনা বলা অমনি ঠানদিদি আর শ্যামাদাসকাকা হুড়মুড় করে গিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকল।