বিরিঞ্চিদাও কম যায় না। সে বললে, আমার জীবনেও কি মুক্তোর মালা নেই নাকি? জানিস, যেবার আমি প্রথম বার বি.এ. পরীক্ষা দিই, শেষদিন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, দেখি সামনে এক সন্ন্যিসী। কী করি ট্রামভাড়া ছাড়া হাতে একটি পয়সা নেই। তাই-ই দিয়ে দিলাম। সন্নিসী বললেন, ব্যাটা তোকে পাস করানো কারো কম্ম নয়, তবে এই জিনিসটা নে, কিছুটা শান্তি পাবি। বলে একটা ছোটো পুটলি দিলেন। বিকেলে বাড়ি গিয়ে খুলে দেখি ঠিক এইরকম একটা মুক্তোর মালা।
আমি বললাম, অ্যাঁ। তারপর সেটার কী হল?
বিরিঞ্চিদা বলল, দুঃখের কথা আর বলিস কেন। ভুলে সেটা সুদ্ধই জামাটা বোপর বাড়ি দিয়েছিলাম। তা ধোপর বাড়ি থেকে একটা পেনসিল ফেরত পাওয়া যায় না, ও কি আর ফিরে আসে! ধোপাটাও আবার পরদিন থেকে নিখোঁজ। হয়তো এসব বিশ্বাস করবি না।
আমিও এ কথা শুনে বললাম, ও হ্যাঁ, আমারও মনে পড়ছে—
ওরা তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, চোপ্। ফের বানাচ্ছিস!
ঠানদিদি নিশ্বাস ফেলে বলে যেতে লাগলেন, ইস্, ভাবতে গিয়েও আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে হাঁসের গায়ের মতো হয়ে গেছে। সেবার সেই যে মেমের পালক-দেওয়া টুপি দেখে ভয় পেয়ে, চিড়িয়াখানার খাঁচা ভেঙে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল, তোদের কারো মনে নেই? তবে মনে থাকা শক্ত, কারণ তোরা কেউ ছিলি না। সেই যে সব একতলার দরজা জানলা বন্ধ করে দোতলায় বসে থাকতে হয়। উঃ! এখনও মনে করলে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদোয়। তার মধ্যেও সেজোপিসিমা মালাগাছি প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছিলেন। শেষে কিনা– বলে ঠানদিদি চোখে আঁচল দিলেন।
শ্যামাদাসকাকা একটু যেন রাগ রাগ ভাব করে বলল, থামো দিকিনি। মনের দুঃখুগুলো এখনকার মতো চেপে রেখে, কী করা যায় তাই ভাবা যাক।
ঠানদিদি বিরক্ত হয়ে বললেন, তা শুনতে ভালো লাগবে কেন? মালাটা কি তুই সহজে হাতছাড়া করবি? বেশ, চল, যা হোক কোথাও একটা ব্যবস্থা করা যাক। ওঠ, চল।
শ্যামাদাসকাকা বলল, চল বললেই তো আর চলা যায় না। আসল কথা হল ও গাড়ি এখনকার মতো এক ইঞ্চিও চলবে না। ওর তেল ফুরিয়ে গেছে, ওর সব কটা টায়ার ফুটো হয়ে গেছে, তা ছাড়া কিছুক্ষণ ধরে ওর পেটের ভেতর থেকে কীরকম একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে, সে আমি একেবারেই ভালো বুঝছি না।
বিরিঞ্চিদা বেজায় চটে গেল, ইয়ে, টায়ার সব ফুটো করে দিয়েছ? ওর দাম কত তা জান? আর গোঁ গোঁ শব্দও তো আগে ছিল না।
শ্যামাদাসকাকা আরও বলল, তা ছাড়া রাস্তাও তো এইখানে শেষ হয়ে গেছে, এখন উপায়টা কী হবে তাই বল।
এই বলে তিনজনেই আমার দিকে চেয়ে রইল।
আমি বললাম, কী আবার হবে? চলো, হাঁটা দেওয়া যাক। হেঁটে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেওয়া যাক। সেখানে মাথা গোঁজা যাবে, ফন্দিও পাকানো যাবে।
ঠানদিদি চটে গেলেন।
ফন্দি পাকানো আবার কী? কোথায় শিখিস এসব কথা? তা ছাড়া ওই লাখ টাকার মালা হাতে নিয়ে, এই ভর সন্ধ্যে বেলা, অঘোর বনের মধ্যে হেঁটে বেড়াব? বেঘোরে অচেনা আস্তানায় আশ্রয় নেব? তোর প্রাণে কি একটুও দয়ামায়া নেই রে?
বললাম, বেশ, তা হলে হেঁটো না, গাড়িতেই বসে থাকো, হুণ্ডারে খেয়ে নিলে আমাকে বোলো! তোমাদের পেছনে না হুলিয়া লেগেছে?
এই বলে আমার দিকের দরজাটা খুলে নেমে পড়লাম।
হুলিয়ার কথা শুনেই ওরাও এ-ওর পা মাড়াতে মাড়াতে ঠেলাঠেলি করে নেমে পড়ল।
উঃ! বসে থেকে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছিল! খানিক হাত-পা সোজা-বাঁকা করে, বাবা যেমন বলেছিলেন, সেইরকম করে খিল ছাড়ালুম। ওরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। তার পর বিরিঞ্চিদা বলল, যত ঢঙ! নে, নে, গাড়ির কাচটাচ তোল, দরজাগুলো এঁটে দে! আমারও যখন-তখন হাতে-পায়ে খিল ধরে যায়।
টিফিন-ক্যারিয়ারে দু-চারটে লুচি-টুচি যা পড়ে ছিল পকেটে ভরে নিলাম, তার পর পেছনের জানলা দরজা বন্ধ করলাম।
তখন শ্যামাদাসকাকা বলল, আর, হ্যাঁ, দ্যাখ, আমি যা ভুলো মানুষ, মালাটাও বরং তোর কাছেই রাখ, আমি আবার কোথায় হারিয়ে ফেলব।
বলে মালাটা একরকম জোর করে আমার হাতের মধ্যে গুঁজে দিল। বেশ একটু হাসি পেল আমার।
মালা হাতে নিয়েই জানলা তুলতে লাগলাম। তারার আলোতে মুক্তোগুলো ঝিকমিক করতে লাগল।
হঠাৎ আমার গা শিউরে উঠল, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল! যা ঘটবার নয়, তাই ঘটে গেল।
কিন্তু কেউ কিচ্ছু খেয়াল করল না। তাই আমিও স্রেফ চেপে গেলাম।
০৪. সে কী ঘন বন
সে কী ঘন বন। চার দিক থেকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। খোলা জায়গায় তবু চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম, এখানে তারার আলো পৌঁছায় না। হাজার হাজার বর্ষার জল খেয়ে খেয়ে গাছপালাগুলো অসম্ভবরকম বেড়ে গিয়ে, মাথার ওপরেও আরেকটা জমাট অন্ধকার বানিয়েছে। তার ওপর বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সেই বৃষ্টির জল পাতা থেকে পাতায় খসে, টুপটাপ করে আমাদের গায়ে মাথায় ঝরে পড়ছে। সে যে কী দারুণ ঠান্ডা ভাবা যায় না। পায়ের নীচে ঝরাপাতার গালচে পাতা, পায়ের শব্দ শোনা যায় না। শুধু একটা শুকনো ডালে কারো পা পড়লে, সেটা মটাত করে ভেঙে যাচ্ছে, আর সেই শব্দে চারদিকটা ঝনঝন করে উঠেছে। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
সকলের মনে দারুণ দুশ্চিন্তা, বিশেষ করে আমার নিজের মনে। তার কারণ খানিক আগেই যে সর্বনাশটা হয়ে গেছে, সে বিষয় কাউকে কিছু বলবার সাহস নেই আমার।