টিফিন ক্যারিয়ার খুলে দেখি লুচি, পটোলভাজা, আলুরদম, মাংসের বড়া, জিবেগজা। যদিও ডিমের ডেভিল, শোনপাপড়ি মোটেই নেই। দরজার খোপে পুরোনো খবরের কাগজ ছিল, তাতে করে যত্ন করে ওদের খাওয়ালাম। শ্যামাদাসকাকা কুড়িটা লুচি খেল; বিরিঞ্চিদারও দেখলাম ভয়ের চোটে খিদে বেড়েছে। খালি ঠানদিদি নাক সিটকে একটু দূরে বসে ফলমূল খেলেন।
কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ খুশি হল বলে মনে হল না। খাবার পর জল খেয়ে, পকেট থেকে একটি লোমওয়ালা ল্যাবেঞ্চস বের করে মুখে পুরে, যেই বলেছি, আঃ! কী আরাম!
অমনি ওরা সব রুখে উঠল, আরাম? আরামটা কোথায় পেলি তাই বল! এখন কী উপায় হবে শুনি? সামনে অঘোর জঙ্গল, পেছনে শব্দুর, এখনি বিকেল হয়ে এসেছে, রাত হতে কতক্ষণ? কী উপায় হবে এবার বল!
বললাম, শ্যামাদাসকাকা যদি জঙ্গলের মধ্যে ইচ্ছে করে না ঢুকত, তাহলে এতক্ষণে আমরা
এমনি সময় ঠানদিদি হঠাৎ চেঁচিয়ে-মেচিয়ে এক লাফে গাড়িতে উঠে পড়ে বললেন, ওরে বাবা রে! বাঘ!
আমিও গাড়িতে উঠে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে, তাকিয়ে দেখি একটি মোষ প্যাটার্নের জন্তু। বিরিঞ্চিদা তাড়া দিতেই চলে গেল। সত্যি, মেয়েরা যে কী দারুণ ভীতু হয়।
একটু পরেই একটা ব্যাং দেখলাম, থপ থপ করে কতকগুলো কালো পাথরের ফোকরের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ফোকরের মধ্যে ব্যাঙের চোখ জ্বলজ্বল করছে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিছু ভয় পাইনি। ঠানদিদিকে কিছু বলিনি পর্যন্ত। কী জানি যদি শেষটা ওঁর হাত পা এলিয়ে যায়। মেয়েদের কিছু বলা যায় না।
খানিকবাদে বিরিঞ্চিদা বলল, কই, দেখি তো মালাটা। ই-স্! লাখ টাকার জিনিস রে শ্যামাদাস। ধরা না পড়িস যদি, রাতারাতি রাজা হয়ে যাবি। তবে যদি ধরা পড়িস– আর সেটারই চান্স বেশি– তা হলে বাকি জীবনটা ঘানি টেনে কাটাবি।
আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি দেখেছি, চোখে নারকোল মালার তৈরি চশমা বেঁধে দেয়। নইলে মাথা ঘোরে।
অমনি শ্যামাদাসকাকা ঠাস করে আমার গালে একটা চড় কষিয়ে, মালাটাকে টেনে ঘাসের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল।
সবুজ ঘাসের ওপর মুক্তোগুলো জ্বলতে লাগল, যেন কে সারি সারি বাতি দিয়েছে।
বিরিঞ্চিদা গিয়ে কুড়িয়ে আনল
দেখলাম মাঝখানে আবার একটা মস্ত হিরে ঝোলানো। শ্যামাদাসকাকাকে হুলিয়ায় ধরলে ঠিক হত! কিন্তু তাহলে গাড়ি কে চালাত?
০৩. চার দিকে চেয়ে দেখলাম
চার দিকে চেয়ে দেখলাম। মাথার ওপর বট গাছটা মেঘের মতো অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে। কতকগুলো ঝুরি মাটিতে নেমেছে, কতকগুলো শূন্যে ঝুলছে, বাতাস লেগে একটু একটু দুলছে, আর ডালের ভেতর দিয়ে, পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো, কেমন-একটা সবুজ রং ধরে আমাদের গায়ে এসে পড়েছ। শিরশির বাতাস বইছে।
শ্যামাদাসকাকা বিরিঞ্চিদার হাত থেকে মালাটা ছিনিয়ে নিয়ে আবার পকেটে পুরে ফেলে বলল, এসব সামান্য জিনিসে আমার কোনো লোভ নেই রে বিরিঞ্চি। ও মালা আর কী দেখাচ্ছিস? জানিস আমার ঠাকুমার গায়ে দুপুরে এক লাখ টাকার আর সন্ধ্যে বেলায় তিন লাখ টাকার গয়না থাকত। এত গয়না ছিল যে নিজেই জানতেন না কী আছে না আছে। ওঁদের বাড়িতে বাইরে থেকে গয়না পরে কেউ যদি আসত, তো মনে করতেন বুঝি ওঁরই গয়না নিয়েছে! এমনি করে কত যে শব্দুর তৈরি করেছিলেন। শেষটা তাতেই ওঁর কাল হল!
আমি বললাম, কেন, কেন, কী হয়েছিল?
শ্যামাদাসকাকা বললে, আঃ, গল্প বলবার সময় হুড়ো দিতে হয় না। কী রূপ ছিল তার তা জানিস? ওঁর পাশে যে দাঁড়াত তাকেই বাঁদরের মতো দেখাত। দুধের মতো রং, গোড়ালি পর্যন্ত কালো কোঁকড়া চুল, কান পর্যন্ত টানা চোখ, মুক্তোর সারির মতো দাঁত। তিন লাখ টাকার গয়না পরে শুতে যেতেন!
আমি বললাম, ই–স্! তারপর কী হল? নিশ্চয় খারাপ কিছু?
শ্যামাদাসকাকা বকে যেতে লাগল, একদিন সকালে উঠে দেখেন সব চুরি গেছে। শত্তুরের তো আর অভাব ছিল না। রাতারাতি কে এসে গা থেকে সমস্ত খুলে নিয়ে চলে গেছে। ঠাকুরমা টেরও পাননি। সকাল বেলা তাবিজ ঢিলে হয়ে গেছে মনে করে কনুই খামচাচ্ছেন; চেয়ে দেখেন কোথায় তাবিজ! সোনার তাবিজ নেই, হিরের রতনচূড় হাওয়া, নীলকান্ত মণি-বসানো চরণ পদ্ম, ফিরোজা-দেওয়া মুক্তোর সাতনরি, কিচ্ছু নেই। নাকছাবিটা অবধি খুঁটে তুলে নিয়ে গেছে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শ্যামাদাসকাকা বলল, আমার মন বলছে এই মালাটাও সেই চুরিকরা জিনিসেরই একটা। কিছুরই ফর্দ করা তো আর ছিল না। তবে এটার কতই-বা দাম হবে? বড়ো জোর বিশ-পঁচিশ হাজার!
বিরিঞ্চিদা সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, দ্যাখ শ্যামাদাস, তোর মনে পাপ ঢুকেছে; তুই খুব ভালো করেই জানিস এটা সেই জমিদার গিন্নির মালা। হয়তো ওই লুঙ্গিপরা লোকটার সঙ্গে তোর ষড় ছিল। দেখিস এরজন্য তোকে ঝুলতে হবে।
দেখলাম হিংসায় বিরিঞ্চিদার মুখটা সবুজ হয়ে গেছে।
শ্যামাদাসকাকাও দেখলাম দারুণ রেগে গেছে, আমি ঝুলব মানে? বাঃ বেশ বললি যা হোক! তুই আর পিসিমা–
বিরিঞ্চিদা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে শ্যামাদাসকাকার মুখটা চেপে ধরে নাক দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললে, স্-স-স-স চুপ কর ভাই। বলেছি তো তোকে চীনে হোটেলে চ্যাং-ব্যাং খাওয়াব। তা ছাড়া তোর নিজেরও তো–
সবাই চুপ করল।
ঠানদিদি মোষ দেখার পর আর কথা বলেননি। এখন হঠাৎ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হরি হে, সবই তোমারই ইচ্ছে। নইলে আমারই-বা সেজোপিসিমার মুক্তোর মালা বাক্স থেকে বেমালুম অদৃশ্য হবে কেন। ভাবতে পারিস তোরা, খাটের তলায় বাক্স, বাক্সের ওপর সের পঁচিশেকের সাঁড়াশি বারকোশ, বাক্সের মুখ মোটা ছাগলদড়ি দিয়ে বাঁধা, খাটের ওপর অষ্টপ্রহর সেজোপিসিমা শুয়ে। আমার বিয়েতে ওই দিয়ে আশীর্বাদ করবেন বলে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, বছরের পর বছর মালা আগলাচ্ছেন। কবে আমার বিয়ে হবে। এদিকে আমি তখনও জন্মাইনি পর্যন্ত! শেষটা একদিন দেখেন কিনা বাক্সের মুখ যেমন দড়ি দিয়ে তেমনি দড়ি দিয়েই বাঁধা; সাঁড়াশি বারকোশ যেমনকে তেমন; খালি বাক্সর মধ্যে লাল চেলির টুকরোয় বাঁধা মালাগাছি নেই। সেই শোকেই তো আমি জন্মাবার আগেই সেজোপিসিমা গেলেন! নইলে কী আর এমন বয়স হয়েছিল! মাত্র একাশি বচ্ছর। অথচ ওঁরই মা দিদিমারা হেসে-খেলে সাতানব্বই আটানব্বইটি বচ্ছর কাটিয়েছিলেন। হরি-নারায়ণ! এ মালাটা যেন অবিকল সেই। একরকম বলতে গেলে এটা আমারই মালা!