ঠানদিদি হাঁড়িমুখ করে বললেন, এ বেঘোরে সে আমি কোথায় পাব?
মেয়েদের যা কাণ্ড, সঙ্গে একটা দরকারি জিনিস অবধি রাখে না। বললাম, তা হলে একটা লাইন-টানা রুলার হলেও চলবে।
সবাই চুপচাপ। বললাম, তা হলে কি জিনিসের অভাবে সব পণ্ড হয়ে যাবে?
তখন শ্যামাদাসকাকা গাড়ির ভেতরের খোপ থেকে একটা লম্বা শক্ত তার বের করে দিল। আমি সেটি নিয়ে সামনের বাঁ-দিকের জানলার ভেতরে গুঁজে দিয়ে অনেক কসরত করে মালাটা বের করলাম।
কাল জানলার কাচ তোলবার সময়, হাত থেকে ফসকে কাচের পাশ দিয়ে, খাঁজের ভেতর পড়ে গেছল।
মালাটাকে পেন্টেলুনে ঘষে তুলে দেখালাম। মাঝখানকার হিরেটা ধুকধুক্ করতে লাগল। জমিদারবাবু ছুটে এসে বললেন, আরে এই তো আমার হারানিধি! এরই জন্যে তো আমি ঘরছাড়া। দে রে বাপ, একটু বুকে করি।
সঙ্গেসঙ্গে ইনসিওরেন্স কোম্পানির লোকেরাও এগিয়ে এল। তাদের মধ্যে একজনের চোখ হঠাৎ ছোটো হয়ে উঠল।
–সে কী মশাই! এটাও যে মেকি।
আমরা ধমক দিয়ে উঠলাম, বললেই হল মেকি। এইটেই জমিদারবাবুর গিন্নির আদত মালা। মেকি হবে কেন।
সে লোকটা কিছুতেই থামবে না। আরে মণি চেনাই আমার পেশা। তারজন্য এরা আমাকে তিন-শো টাকা মাইনে দেয়, আমি নকল মুক্তো চিনব না? কী যে বলেন। এ যদি সাচ্চা হয় তো আমি।
জমিদারবাবু বললেন, স-স-স–চুপ চুপ, ওকথা মুখে আনবেন না, গত বছর নেহাত ঠেকায়। পড়ে সেটি বেচতে বাধ্য হয়েছিলাম। তা এটাই-বা মন্দ কীসের? পঁচিশ টাকার পক্ষে কী-এমন। খারাপ বলুন? গিন্নিই যখন টের পাননি, আপনাদের আর কি আপত্তি থাকতে পারে?
তারা বললে, আপত্তি কিছুই নয় তবে কোম্পানিতে রিপোর্ট করে দিতে বাধ্য আমরা।
তা করুনগে রিপোর্ট, করুন পাসপোর্ট, খালি আমার গিন্নি যেন না শোনেন। চেপে যান মশাই, পাঁচ টাকা খাইয়ে দেব সবাইকে।
দাড়িওয়ালা বলল, পাঁচ টাকাই নেই আপনার, খাওয়াবেন কী দিয়ে?
ইন্সপেক্টর বললেন, সবই বুঝলাম বাড়ির তলার গোলকধাঁধা ছাড়া।
বুড়ি বললে, বলুন আমাদের সবাইকেই ছেড়ে দেবেন, তা হলে বলি। খোকা ইস্কুলে পড়বে, আমরাও রিটায়ার করব।
ইন্সপেক্টর হাসলেন, কাজটা আপনারা যে খুব ভালো করেছেন বলছি নে; তবে কিনা আপনাদের নামে তো আর কেস হচ্ছে না ঠাকরুন। জমিদারবাবুর গিন্নির মালা খুঁজে দেবার কথা, সে তো দিয়েইছি। গিন্নিমাই আমাকে পুরস্কার দেবেন। আপনাদের নামে কেস যখন হবে তখন হবে। আপাতত জিনিসগুলো সব জমা দিয়ে দেবেন।
বুড়ি বললে, আর আমার খোকা?
শম্ভু বলল, ঘুস খায়, আবার খোকা!
খোকা রেগে গেল। এক পয়সা পেলাম না মশাই, আবার ঘুস খাই, মানে?
জমিদারবাবু দাড়িওয়ালার দিকে তাকালেন। সে বললে, নেই বলছি ওঁর টাকা।
বুড়ি বলল, শুনুন তা হলে। সেকালে বাড়িটা ছিল এক সাহেবের। সে জুতো পচিয়ে এখানে মদ তৈরি করত। দেখতে দেখতে বড়োলোক হয়ে গিয়ে দেশে চলে গেল। পরে সে লাটসাহেব না বড়ো ডাক্তার না কী যেন হয়ে আবার এসেছিল। খুব সস্তায় বাড়ি বেচে দিয়ে গেল। ঠাকুরদা কিনে রাখলেন, বাবা আমাকে যৌতুক দিলেন। অমন ভালো সুড়ঙ্গ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে দেখে, আমরা ওগুলোকে একটু কাজে লাগালাম। দোষ তো আমাদের এইটুকু।
ইন্সপেক্টরবাবু খাতা পেনসিল পকেটে পুরে জমিদার গিন্নির মালা হাতে নিয়ে জমিদারবাবুকে বললেন, চলুন।
বুড়ি আর বেচারা ভদ্রলোক ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে অনুনয়-বিনয় করতে করতে চললেন।
অমনি কর্পূরের মতো সবাই যার যেখানে মিলিয়ে গেল। পিসেমশাই, সেজোদাদামশাই পর্যন্ত চলে গেলেন। বাকি রইলাম আমি ঠানদিদি, বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা।
আমরা ফ্যালফ্যাল করে এ-ওর দিকে চেয়ে রইলাম। খানিক বাদে আমি বললাম, এক ডজন চুইংগাম কি সত্যি কেউ কাউকে দেয়!
বিরিঞ্চিদা আর শ্যামাদাসকাকা একসঙ্গে বলে উঠল, কক্ষনো দেয় না। বরাবর তোকে বলছি-না জীবনটা হচ্ছে খানিকটা রাবিশ, একটা ডাস্টবিন। এখন চল, একটা কারখানার চেষ্টা করা যাক।
ভারি খুশি লাগল, ভাবলাম বগাই নিশ্চয় আমাকে কাল সারা দিনরাত খুঁজেছে!